৯ জুলাই ২০২৫ বুধবার
প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৫, ১১:১৫ পিএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

এনসিপির ‘মাফিয়া’ হয়ে ওঠা

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৫, ১১:১৫ পিএম

একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে অন্যতম প্রধান ভূমিকাই ছিল নবগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারকে হটাতে এনসিপির শীর্ষনেতৃত্ব তথা হাসনাত-সারজিস-নাহিদদের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাদের আপসহীনতা, অনমনীয় মনোভাব, দায়বদ্ধতা আর ত্বরিত সিদ্ধান্তগ্রহণের কারণেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিজম।

১৭ বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো এই দেশের সিনার ওপর বসে থাকা দানব আওয়ামী লীগকে রীতিমতো বিতাড়িত করে এই ছাত্রদের নেতৃত্বে লাখো জনতা। যদিও অন্যদের মতো আমিও এই ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের একক কৃতিত্ব এই ছাত্রদের দিতে চাই না কোনোভাবেই; তারপরও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে, শেখ হাসিনা ও তার পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে, মৃত্যুদূতের চোখে চোখ রেখে তারাই তো জয় ছিনিয়ে এনেছে।

এদেশের মানুষ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। অদম্য এই তরুণদের প্রতি এদেশের মানুষ ভীষণ কৃতজ্ঞ। একজন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া না হলে আজও হয়তো ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ হতো না। আজও হয়তো আধাঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হতো না শেখ হাসিনাকে- পালাবার জন্য।

তবে এ বিজয় কিন্তু একা আসিফ-হাসনাত-সারজিস-নাহিদদের নয়। তাঁরা একটি ক্ষুদ্র অংশ, বলা যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। এতে অংশগ্রহণ আছে ১৭ বছর ধরে এই ভয়াল অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করা, কারানির্যাতিত, হামলা-মামলা-হত্যা আর গুমের শিকার, চরম দমন-পীড়নের শিকার হয়েও আপসহীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), ধর্মভিত্তিক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে বিতর্কিত ইসলামিক মুভমেন্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগুণতি ছাত্র-ছাত্রী (বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য), পোশাকশ্রমিক, রিকশাওয়ালা, অটোচালক, দিনমজুরের। আছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা, তাদের অভিভাবক, সিনিয়র সিটিজেন; আরো আরো অনেকেরই।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০ মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। দেশে অন্তবর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা চলমান। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ দেশ পরিচালনা করছেন। এঁদের উদ্দেশ্য যথাসাধ্য সংস্কার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও তারপর একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রকে সমর্পণ করা।

তবে যেই ছেলেদের হাত ধরে এত পরিবর্তন তাদের কাছে যা চাওয়ার ছিল তা পায়নি এদেশের মানুষ। তারা মনে করেছিল- এরা হয়তো অন্যদের মতো হবে না। এরা দেশের শীর্ষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, সুশিক্ষিত, নীতিবান। এরা রাজনীতিবিদদের মতো হবে না। তবে ঘটল ঠিক তার উল্টোটা।

এরা আস্ফালন শুরু করল। এরা এমন আচরণ শুরু করল যাতে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা হটানোর একমাত্র স্টেকহোল্ডার তারাই। যা তাদের অধিকারবহির্ভুত তারা তা-ই করা শুরু করল। তারা সরকারের ভেতর আরেকটি সরকার হয়ে ওঠার চেষ্টা করল। তারা হুমকি দেওয়া শুরু করল, ধমকি দেওয়া শুরু করল।

১০ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও তাঁরা শহীদ ও আহতদের সঠিক তালিকা করতে পারল না। তারা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারল না। তারা সরকারকে চাপ দিয়ে শাহবাগ অবরুদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারল কিন্তু পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহতদের পরিপূর্ণ চিকিৎসা করাতে পারল না। তারা পারল গাড়ি আর মোটরসাইকেলের শো-ডাউন করতে। তারা পারল বিতর্কের পর বিতর্কের জন্ম দিতে।

বিতর্ক যখন এনসিপির পিছু ছাড়ছে না ঠিক তখনই সে আগুনে ঘি ঢাললেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য জোবায়ের আলম মানিক। গতকাল সোমবার (০৯ জুন) চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কালাবিবির দিঘির মোড়ের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এনসিপি আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা শাখার আয়োজনে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বললেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা ১৬-১৭ বছরের এক ‘মাফিয়া’কে হটাতে পেরেছি। এখন যদি কেউ আবার মাফিয়া হতে চায়, তাদের বলতে চাই- এদেশে আমাদের চেয়ে বড় মাফিয়া আর কেউ নেই।’

তবে কী এনসিপিই এখন এদেশের সবচেয়ে বড় মাফিয়া? যদিও জোবায়ের আলম মানিক পরে বিতর্কের মুখে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন- তার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও পরে ধারণকৃত একাধিক ভিডিও ক্লিপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- তিনি সত্যিই ঠিক উপরি-উল্লিখিত কথাটাই বলেছেন। দম্ভের সাথে নিজেদের মাফিয়া দাবি করেছেন এনসিপির এই কেন্দ্রীয় নেতা।

হাসনাত-সারজিস-নাহিদ-আসিফরা কী দেখেননি বছরের পর বছর কিভাবে কারণে-অকারণে রাস্তায় ফেলে কুকুরের মতো পেটানো হয়েছে বাঙলাদেশের শেষ ডাকসু ভিপি নুরুলহক নুরকে। কিভাবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ সিনিয়র মোস্ট বিএনপি নেতাদের রাতের আঁধারে আটক করে জেলে পোরা হয়েছে। ইসলামপন্থিদের ওপর চালানো হয়েছে বর্বরতার স্টিমরোলার। কিভাবে বাঙলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম বড় নাম, সাবেক ডাকসু ভিপি ও ক্যানসার রোগী আমানউল্লাহ আমানকে দিনের পর দিন জেলে রাখা হয়েছে।

তারা যদি মনে করেন ২০ দিনে দেশ মাফিয়ামুক্ত হয়েছে তাহলে কী সেটা ভুল হবে না? এই মুক্তি দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, মৃত্যু ও রক্তের গন্ধে মাখা।

আপনারা সেদিন গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন। তাহলে কিভাবে আজ এমন অনাচারের সাথে নিজেদের যুক্ত করছেন? কিভাবে এমন কথা বলছেন, যা জুলাই আন্দোলনে আপনাদের অংশগ্রহণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে?

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x