৯ জুলাই ২০২৫ বুধবার
প্রকাশ : ৬ জুলাই ২০২৫, ১২:৪২ এএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

সম্পাদকের কাঁঠাল

প্রকাশ : ৬ জুলাই ২০২৫, ১২:৪২ এএম

পত্রিকা সম্পাদকদের নানা অভ্যাসের কথা অনেকেরই জানা। দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের বেশি সময় গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে অনেক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুঁদে-জাঁদরেল-জবরদস্ত। কেউ কেউ সরল-একাগ্রচিত্ত। আবার কেউ কেউ আপসহীন, কেউ আবার ক্ষেত্রবিশেষে আপসকামী। কেউ আমিষভোজী, কেউ নিরামিষাশী। এভাবে তাঁদের বর্ণনা করা যায়, করলে কেউ এই হতভাগাকে আপত্তির খাতায় টুকবেন না।

আমি যখন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমে আমার পথচলা শুরু করছি তখন শাহাদাত ভাই (শাহাদাত চৌধুরী) প্রায় শেষ করে এনেছেন তাঁর পথচলা। এই ভাবুক সাংবাদিক-সম্পাদক ও ক্র্যাক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার বেশ কিছু অভ্যাস ছিল এবং তা তাঁর অনুজদের কাছে পরিচিতও ছিল বেশ।

একদিনের কথা ভীষণ মনে পড়ে। সম্ভবত ২০০৪ সাল। সাপ্তাহিক ২০০০-এর দপ্তরে গেছি। আমাকে যিনি নিয়ে গেছেন তিনিও তখন বেশ বড়মাপের প্রতিবেদক। তিনি আমাকে তাঁর কক্ষের সামনে নিয়ে গেলেন এবং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি এক আশ্চর্য নীরবতার ভেতর প্রবেশ করলাম। আমরা সামনেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন সময়ের সবচেয়ে আধুনিক সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী। দেখলাম- উনি ওপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন আর একটি বিশেষ কাজ করছেন। কী সেটা তা অনেকেই বুঝতে পারছেন। তিনি নিউজপ্রিন্টের প্যাড থেকে একটা একটা কাগজ খুলে নিচ্ছেন আর সেগুলো লম্বালম্বি করে ছিঁড়ছেন। আমার মতো একটা প্রায় ছয়ফুটি-জীবন্ত মানুষ তাঁর ঘরে ঢুকে আছি, তা যেন তিনি টেরই পাননি। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন সম্পাদনা সহকারী তাঁর ঘরে প্রবেশ করলে তিনি আমার উপস্থিতি টের পেলেন। এর পর আরো বেশ কবার তাঁর দপ্তরে গেছি, এবং প্রায় প্রতিবারই তাঁকে ওই অবস্থায় পেয়েছি। পরে অগ্রজদের কাছে জানতে পেরেছি- এটা তাঁর অভ্যাস। তিনি যখন কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন তথন এভাবেই কাগজ ছেঁড়েন। তিনি যখন ওই কাজটি করতেন তখন কেউ তাঁকে খুব এতটা বিরক্ত করতেন না।

গোলাম সারওয়ার ছিলেন ঋষি টাইপের মানুষ, একটু রাগীও। যাঁরা তাঁর সাথে কাজ করেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন। চৌধুরী ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী) আপাদমস্তক ধোপদুরস্ত আর ভাবুক টাইপের। এখনো ফোন দিলে, তোলেন। কেতাদুরস্ত ঢঙে কথা বলেন। মোর্তোজা (গোলাম মোর্তোজা) ভাই সব সময়ই অন্যরকম। তাঁর সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টি হলো ঘড়ি ধরে ফোনে কথা বলা। এটা আমি বহুদিন দেখেছি, স্রেফ ঘড়ি ধরে কথা বলা।

ওদিকে খান ভাই (নাইমুল ইসলাম খান) বরাবরই মিশুক। তাঁর কাছে কখনো না শুনিনি। আশ্চর্য এক হ্যাঁ-বাচক মানুষ। এই তুখোড় মানুষটা শেষ বয়সে এসে কেন এমন হয়ে গেলেন, আজো পরিষ্কার নয়।

আমার শেষ দুই সম্পাদক ছিলেন সব মিলিয়ে বেশ। দুজনই কথার রাজা। দুজনের কথাই স্তব্ধ হয়ে শুনতে হতো। মিলন ভাই (ইমদাদুল হক মিলন) যেমন বাকপটু তেমনই রসিক আর মামুন ভাই (মোস্তফা মামুন) দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ। মিলন ভাইয়ের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি টানত তা হলো তাঁর পাঠাভ্যাস। তিনি প্রচুর পড়তেন। এবং সেসব মনেও রাখতে পারতেন। সাহিত্য আর সাহিত্যিক বিষয়ে তিনি ছিলেন রীতিমতো পণ্ডিত। এদুটি বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করে তাঁর কাছ থেকে সঠিক উত্তর ছাড়া ফিরিনি।

মামুন ভাই আমার শেষ সম্পাদক। ভীষণ করিৎকর্মা, চটপটে-ছটফটে এবং তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন মানুষ। তাঁর স্মরণশক্তি রীতিমতো মিথের পর্যায়ে। এবিষয় নিয়ে আরেকদিন লিখব।

যে বিষয়ে কথা বলার জন্য এত কথা বলা সেটাই এখনো বলা হলো না। গল্পটি মূলত একটি কাঁঠালের। আর তার জন্যই এত কথা। আমি আমার একটি টোয়েন্টিফোর ইনটু সেভেন অনলাইন প্রজেক্টে প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেছি গত ০১ জুন। আমরা গুছিয়ে উঠছি। শিগগিরই বেশ বড় পরিসরে শুরু করার ইচ্ছা। মাল্টিমিডিয়া-বেজড অনলাইন এবং স্টুডিও-বেজড ব্রডকাস্ট। এই আমাদের লক্ষ্য। অ্যান্ড উই গনা বি সামথিং হিউজ। যাই হোক নিজের বড় হতে চাওয়ার গল্প করার সময় এখন না।…মূল কথায় আসি।

আমরা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে অফিস করতে চাই। সেই সাথে ঢাকাকে ঘিরে থাকা চারটি জেলা—গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ (টাঙ্গাইলের সাথে ঢাকার সীমানা কম থাকায় ওই জেলাটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে) স্থাপন করতে চাই ব্যুরো। যেহেতু ঢাকার আর বড় হওয়ার সুযোগ নেই এবং উল্লিখিত জেলাগুলো এবং সেখান থেকে আসা মানুষেরা ঢাকার সাথে ভীষণভাবে কানেকটেড তাই মোট পাঁচটি জেলা মিলিয়েই একটি সুপার মেট্রোপলিটনের কথা ভেবেছি আমরা। ঢাকার সব ভালো এবং সব খারাপ প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে যাচ্ছে এই চার জেলাতেও। তাই এই চার জেলাতে আমরা স্থাপন করতে চাই একটি করে ব্যুরো।

গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে গাজীপুর ব্যুরো। জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক পদমর্যাদার একজনকে ব্যুরোপ্রধান করা হয়েছে। তাঁর অধীনে কাজ করবেন একজন মহানগর প্রতিবেদক, একজন আঞ্চলিক প্রতিনিধি, দুজন জেলা প্রতিনিধি ও দুজন উপজেলা প্রতিনিধি। তাঁদের সবার হাতে নিয়োগপত্র এবং পরিচয়পত্র প্রদানের মাধ্যমে কাজ শুরু করল গাজীপুর ব্যুরো।

সবার সাথে খাওয়াদাওয়া করে এবং তাদের বিদায় দিয়ে আমার কক্ষে এসে বসলাম। ব্যুরোপ্রধান বললেন, পরে যাবেন। আমি ক্লান্ত বোধ করছিলাম তাই নিজের কক্ষে এসে বিশ্রামের জন্য বসলাম। একটু পর দরজা খোলার শব্দে মাথা তুললাম, দেখলাম গাজীপুর ব্যুরোপ্রধান দরজায় দাঁড়িয়ে ঢোকার অনুমতি চাইছেন। তিনি ঘরে ঢুকলেন, দেখলাম তাঁর হাতে একটি প্লাস্টিকের বড় ব্যাগ। তিনি সামনের চেয়ারে বসলেন। আমরা কথা বলা শুরু করলাম। এর মাঝে বার বার দেখছি তিনি নিচের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কৌতূহলী হয়ে টেবিলের নিচ দিয়ে তার পায়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সেই প্লাস্টিকের বড় ব্যাগটা। ভেতরে বোধহয় বেশ ভারী কিছু আছে।

আমি নিচের দিকে তাকাতেই উনি বেশ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, একেবারে আমার গাছের কাঁঠাল। আসার সময় কেটে নিয়ে এসেছি। এখনো কষ ঝরছে। আপনি গ্রহণ করলে খুশি হব, সম্পাদক সাহেব।

আমি হতবাক। এই মানুষটা এতটা দূর থেকে এত কষ্ট করে নিজের গাছের কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন। বিষয়টি বিব্রতকর, উপভোগ্যও বটে। আমার ভালো লাগল, আবার তিনি আমার জন্য এতটা কষ্ট করলেন এটা ভেবে খারাপও লাগল। না নিলে বেচারা কষ্ট পাবে এটা ভেবে বললাম, ঠিক আছে রেখে যান। বের হয়ে যাওয়ার সময় বিনীতস্বরে বললেন, আমার নিজের গাছের কাঁঠাল, খুব সুস্বাদু। আপনি খেলে আমি খুব খুশি হব। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি খাব।

তিনি বিদায় নিলেন। আমিও কিছুক্ষণ পর উঠলাম। দেখলাম, টেবিলের পাশেই রাখা পলিথিনের বড় ব্যাগ। ওটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, মার্কার কলম দিয়ে স্পষ্ট করে লেখা আছে—সম্পাদকের কাঁঠাল। লেখা পড়ে আমি হতভম্ব! এ আবার কেমন কথা! তাঁর বিনীতস্বর মনে পড়ে গেল—আমার নিজের গাছের কাঁঠাল, খুব সুস্বাদু। আপনি খেলে আমি খুব খুশি হব।

আর কিছু না ভেবে অটোরিকশা ডাকতে বললাম। সম্পাদকের কাঁঠাল বাড়ি যাবে।

সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার সময় আমাকে সাহায্যকারী ছেলেটিকে বললাম, কাঁঠালটি সিটের ওপর রাখ। সম্পাদকের কাঁঠাল ফুটবোর্ডে বা পায়ের কাছে রাখা সমীচীন হবে না। আমার সাথে আমার পাশে বসে দুলতে দুলতে বাড়ির পথ ধরল, সম্পাদকের কাঁঠাল।

3 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x