১ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ২:১৮ এএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

আরেকটি ‘বিশ্বজিৎ হত্যা’ দেখল দেশ

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ২:১৮ এএম
আরেকটি 'বিশ্বজিৎ হত্যা' দেখল দেশ

ঘটনা ১

৯ ডিসেম্বর, ২০১২; রবিবার। সময় সকাল ৯টা সাড়ে ৯টা। প্রকাশ্য-দিবালোকে শত শত মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগকর্মীরা, বিনা কারণে।

সেদিন সকাল থেকে ঢাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। পেশায় দর্জি বিশ্বজিৎ দাস (২৫) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হেঁটে পার হওয়ার সময় আন্দোলনে বাধাদানকারীদের হামলার মুখে পড়েন। শীর্ণদেহী সেই সনাতন ধর্মাবলম্বী যুবকের ওপর ‘শিবির’ ‘শিবির’ বলে হামলে পড়ে ছাত্রলীগ। নির্বিচার কিল-ঘুষি-লাথি ছাড়াও তাকে পেটানো হয় মোটা লোহার রড দিয়ে, একপর্যায়ে ব্যবহার করা হয় ধারালো চাপাতি। চাপাতির কোপে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি, তারপরও জীবন বাঁচাতে বার বার উঠে পালিয়ে যেতে চান। এবং বলতে থাকেন- ভাই আমি হিন্দু, শিবির না।

কিন্তু ছাত্রলীগ তাকে বারবার ধাওয়া করে পেটাতে এবং কোপাতে থাকে। অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে হত্যাকারীরা চলে যায়। এর পর মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। রক্তক্ষরণে মারা যান বিশ্বজিৎ।

ওই দিন ১৮ দলীয় জোট সরকারবিরোধী অবরোধ কর্মসূচি ছিল। কমর্সূচির সমর্থনে সকাল ৯টার দিকে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট থেকে সরকারবিরোধী আইনজীবীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে গেলে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আইনজীবীদের ওপর হামলা চালায়। আক্রান্ত আইনজীবীরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এসময় ধাওয়া খেয়ে পথচারী বিশ্বজিৎ দৌড়ে প্রথমে নিকটস্থ একটি ভবনের দোতলায় অবস্থিত একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে আশ্রয় নেয়। ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা ওখানে বিশ্বজিতের ওপর হামলা চালায়। আহত বিশ্বজিৎ প্রাণ বাঁচাতে পাশের আরেকটি ভবনে ঢুকে পড়ে। সেখানেও বিশ্বজিতের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগকর্মীরা। তাকে লোহার রড দিয়ে পেটাতে এবং চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। তার সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। সে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আঘাতে আঘাতে এক পর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

পথচারীদের কয়েকজন বিশ্বজিতকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগকর্মীরা বাধা দেয়। প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় উঠে দৌড় দেয় বিশ্বজিৎ, কিন্তু শাঁখারীবাজারের একটি গলিতে গিয়ে ঢলে পড়ে। পরে ক্ষতবিক্ষত দেহটা এক রিকশাওয়ালা নিকটস্থ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই সব গল্প ফুরিয়ে যায়।

ঘটনা ২

৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার। সন্ধ্যা ৬টা সোয়া ৬টা। রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে ৩৯ বছর বয়সী ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহের ওপর চালানো হয় বর্বরতা।

ঘটনার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দৈর্ঘের বেশ কটি ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায় সেই সৃশংসতা দেখে। অনেকে ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখে দেন- দুর্বল চিত্তের মানুষরা দেখবেন না।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ৪-৫ জন যুবক সড়কে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে বড় আকারের একটি পাথর দিয়ে ওপর থেকে আঘাত করছে। কেউ নিথর শরীরে আঘাত করছে আবার কেউ মাথায় সজোরে আঘাত করছে। এতে ওই লোকটির মাথা থেঁতলে যায় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সড়কটিতে সেসময় অনেক লোক চলাচল করছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি তাই সন্ত্রাসীরা সোহাগকে দীর্ঘ সময় ধরে পাথর দিয়ে থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

লাল চাঁদের বাড়ি কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন পূর্ব নামাবাড়ি গ্রামে। তার পিতার নাম ইউসুফ আলী হাওলাদার। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা করতেন।

ঘটনার সূত্রপাত বেশ কদিন আগে। বেশ কিছু দিন ধরে চকবাজার থানা যুবদল নেতা মহিন, সোহাগের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু সোহাগ টাকা দিতে রাজি হননি। দুমাস আগে মহিন বেশ কয়েকবার হুমকি দেয়। এরপর ৯ তারিখ সোহাগকে একা পেয়ে মহিনসহ ৪-৫ জন মিলে নির্মমভাবে হত্যা করে। মহিন চকবাজার থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিল। তার বিরুদ্ধে মিটফোর্ড হাসপাতালের ফুটপাত ও কেমিকেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সুপারিশ করে চাকরি দেওয়ার কথা অনেকেই জানে।

হত্যার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১৯ জন আর অজ্ঞাত ১৫-২০ জন। আসামি সবাই যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে একজন আছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী, তার নাম স্বেচ্ছাসেবক কালু।

র‍্যাব-পুলিশ ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে দুজনকে। আর আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মনে হয় বিষয়টি জানেন না। কাল সকালে তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন- কই, আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।

আমি দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। আমি দুটো দলের কার্যকলাপের মাঝেও কোনো পার্থক্য দেখি না। একসময় ছাত্রলীগ যা করেছে, এখন যুবদল-ছাত্রদলও তাই করছে। আগে ওবায়দুল কাদের সাহেব বলতেন ‘ওরা ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী’ আর এখন মির্জা ফখরুল সাহেব বলবেন ‘ওরা ছাত্রদল নামধারী সন্ত্রাসী’ এবং ‘সন্ত্রাস ও নির্মমমতার সাথে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই’।

অথচ আজ দুপুরে খুলনায় প্রকাশ্যে দিনের আলোয় মোল্লা মাহবুবুর রহমান নামে দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রাম দা হাতে তার ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এঘটনায় ওই রাতেই সংগঠন থেকে মাহাবুবকে বহিষ্কার করা হয়।) সহসভাপতিকে গুলি করে হত্যা করা করা হয়। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার দুই পায়ের রগ কুপিয়ে কাটা হয়।

ওদিকে সালাহউদ্দিন সাহেব বলবেন, ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিচ্ছিন্ন ঘটনায় দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি। তাহলে কী দল থেকে বহিষ্কার করাই একমাত্র ব্যবস্থা?

তাহলে আমাকেও সাংবাদিকতা থেকে বহিষ্কার করে দিন। সাংবাদিকতার শেকল পায়ে পরে সৌজন্য দেখাতে গিয়ে আমারও তো কটূ কথা বলতে অস্বস্তি বোধ হয়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x