যুক্তরাষ্ট্রের হামলার এক মাস পর ইউরোপের ক্ষমতাধর তিন দেশের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় বসছে ইরান। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আগামী শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য এ বৈঠকে অংশ নেবে ইরান ও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিনিধিরা। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে তেহরান। আলোচনার মূল বিষয় হবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি।
এর আগে ইউরোপের এই তিন দেশ, যাদের একত্রে ই–থ্রি নামে ডাকা হয়, হুঁশিয়ার করে বলেছিল—আলোচনায় ফিরতে ব্যর্থ হলে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। পশ্চিমা দেশগুলো ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও তেহরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে, দাবি করে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
এমন এক সময়ে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা চরমে। গত ১৩ জুন ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়। এরপর দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি হামলা। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের কোম প্রদেশের ফর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ইসফাহান ও নাতাঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালায়। এসব হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পুরো অঞ্চলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
এ সংঘাতের আগপর্যন্ত ওমানি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা চলছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ইরানের স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আলোচনাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে ইরান-ই–থ্রি আলোচনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, শেষবার ইরান ও ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে সরাসরি বৈঠক হয়েছিল গত ২১ জুন, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়—যার ঠিক পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের হামলা হয়।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি ক্রেমলিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পরমাণুবিষয়ক উপদেষ্টা আলি লারিজানির সঙ্গে অঘোষিত এক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ও পরমাণু ইস্যু নিয়ে আলোচনার কথা নিশ্চিত করেছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। যদিও রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত, এবার ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মস্কো সরাসরি তেহরানের পক্ষে কোনো অবস্থান নেয়নি।
২০১৫ সালে ইরান ও ছয়টি বিশ্বশক্তির মধ্যে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তির আওতায় ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়। এর বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে গেলে তা ভেঙে পড়ে।
এরপর ইরান আবারও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও গবেষণায় গতি আনে এবং পশ্চিমা দেশের শঙ্কা বাড়ে। এই বাস্তবতায় শুক্রবারের ইস্তাম্বুল বৈঠককে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা, উত্তেজনা ও সংঘাত আরও বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।