সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন (কেজি স্কুল) সমূহের সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশেই ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে।
আমরা জানি, জার্মান ভাষা থেকে উদ্ভূত কিন্ডারগার্টেন শব্দটি হঠাৎ করেই নতুন আবির্ভূত কোন বিষয় নয়। বলা হয়ে থাকে,ফ্রেডরিক ফ্রোয়েবল ১৮৩৭ সালে ব্যাড ব্ল্যাংকেনবার্গে শিশুদেরকে বাড়ি থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত গমন এবং খেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ধারণাকে কেন্দ্র করে এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, শিশুরা উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিপালিত হবে এবং শিশুদের বাগান হিসেবে কিন্ডারগার্টেনের বাগিচায় রোপিত চারা গাছের ন্যায় পরিচর্যা পাবে।
১৮১৬ সালে স্কটল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন নামীয় একজন দার্শনিক ও শিশু শিক্ষাবিদ নিউ লেনার্কে”ইনফ্যান্ট স্কুল” বা শিশু বিদ্যালয় খুলেন। স্যামুয়েল ওইন্ডার স্পিন কর্তৃক লন্ডনে ১৮১৯ সালে একটি শিশু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কাউন্টেস্ট থেরেসা ব্রোসভিক (১৭৭৫-১৮৬১) উপরের উদাহরণগুলোতে আকৃষ্ট হয়ে বোদাপেস্টে নিজ বাড়িতে ২৭ মে,১৮২৮ সালে “এঙ্গিয়েলকার্ট” বা পরীদের বাগান খুলেন। এ ধারণাটি হাঙ্গেরিয়ান রাজতন্ত্রের মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং এর অনুসরণ করে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে শুরু করে আমাদের ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশেও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রচলন শুরু হয়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও সচেতন,শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশ দ্বারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। যেহেতু অর্থনৈতিক লাভ লোকসানের একটা ব্যাপার এর সাথে জড়িত সে কারণে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও কেউ কেউ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এই বেসরকারি ব্যবস্থাপনার সাথে ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এই কেজি স্কুলগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখছে বলেই অভিজ্ঞ জনেরা মনে করেন।
আর সে কারণেই বোধ হয় ২০২৩ সালে কিন্ডার গার্টেন (কেজি স্কুল ) পরিচালনার জন্য বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা জারি করা হয়। বিধিমালায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর পরিচালনা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নিয়ম কানুন যুক্ত করা হয়েছে। বিধিমালাটি জারির মূল উদ্দেশ্য ছিল,কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোর শিক্ষার মান উন্নয়ন করা এবং শিশুদের শিক্ষার একটি উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
১৮ কোটিরও উপরে বসবাসকারী মানুষের বাংলাদেশে ৬৮ হাজার গ্রামে মাত্র ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় গমন উপযোগী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশের শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরণ সরকারি এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দিয়ে মোটেও সম্ভপর ছিল না। আর সে কারণেই বোধ হয় এরই মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজারের মতো কেজি স্কুল গড়ে উঠেছে।
অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন,ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা এসব কেজি স্কুল দিয়ে গুণগত মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিগত প্রায় এক দশকের বিশ্লেষণ বলে,কেজি স্কুল গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি স্কুলের চেয়ে ভালো ফলাফল করে কৃতিতের স্বাক্ষর রাখছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই যেখানে এমনকি উন্নত দেশে তো বটেই বেসরকারি স্কুলের পৃষ্ঠপোষকতা সরকার আশা করে সেখানে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই কি এমন ঘটনার উদ্ভব ঘটলো যাতে করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হলো।
রাজনৈতিক নানা সমস্যার সমাধান যেখানে জরুরি ছিল সেখানে কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে কার কি লাভ হবে ভেবে দেখা দরকার। কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই বাংলাদেশেরই নাগরিক। সুতরাং বাংলাদেশের সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার তাদের নিশ্চয়ই রয়েছে। বৈষম্য নিরসনের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীরাই জুলাই বিপ্লবের মত রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে জয়লাভ করেছে নতুন কোন বৈষম্য সৃষ্টির জন্য নয়।
অন্তবর্তী সরকারের মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার মত যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন। শুধু তাই নয়,বেসরকারি কেজি স্কুলগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা দিনরাত পরিশ্রম করে আন্তরিকতার ছোঁয়ায় যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেন, ছাত্রছাত্রীদের যক্ষের ধনের মতো বুকে আগলে রেখে যত্ন করে ভালো ফলাফল করার জন্য তৈরি করেন তাদেরকে বঞ্চিত করে কোন সুফল আপনারা পাবেন না।
বরং দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কেজি স্কুলের ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক ও শুভাকাঙ্ক্ষী সহ জনসংখ্যার এই বিশাল অংশ মাঠে নেমে গেলে বড় ধরনের একটা বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা তো থেকেই যায়। সুতরাং সময় থাকতেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুরাহার জন্য সুবিবেচনা করবেন আশা করছি।
এমদাদুল হকের (সহকারী অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা কলেজ) ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া
https://www.facebook.com/share/p/19TXDvPerK/