২ আগস্ট ২০২৫ শনিবার
প্রকাশ : ৯ জুন ২০২৫, ৮:২৩ পিএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

গ্রেটা থুনবার্গ কী এ লড়াইটা জিততে পারবেন?

প্রকাশ : ৯ জুন ২০২৫, ৮:২৩ পিএম

গ্রেটা থুনবার্গ। পরিবেশ আন্দোলনকর্মী। তবে বেশির ভাগ মানুষ তাঁকে চেনেন ‘ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবেই। যদিও এর আগে বহুবারই বিশ্বসংবাদের শিরোনাম হয়েছেন এই ২২ বছরের তরুণী, তবে এবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন এক দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে। হ্যাঁ—এটাকে আপনি নিশ্চয়ই দুঃসাহসী কাজই বলবেন।

ইতিমধ্যে সারা বিশ্ব জেনে গেছে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে গাজাবাসীর জন্য ত্রাণবোঝাই একটি জাহাজ আটক করে সেটিকে জোরপূর্বক নিজেদের বন্দর আশদাদে নিয়ে গেছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজটির নাম ‘ম্যাডলিন’। আর ম্যাডলিন কে সে সম্পর্কেও মোটামুটি জেনে গেছে বিশ্ব।

যাই হোক, প্রথমে আসি গ্রেটা থুনবার্গ প্রসঙ্গে। কে তিনি একটু জেনে নিই ভালো করে। মেয়েটির বাড়ি সুইডেনের স্টকহোমে। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি জন্ম তার, নাম ছিল গ্রেটা টিনটিন ইলিওনোরা এমান থুনবার্গ। পরে অবশ্য নিজের নামের মাঝখানেরটুকু ছেঁটে ফেলেন তিনি, হয়ে যান গ্রেটা থুনবার্গ। মা মালেনা থুনবার্গ অপেরা শিল্পী আর বাবা অভিনেতা সাভান্তে থুনবার্গ। বিয়াটা নামে ছোট একটি বোন আছে তার।

মাত্র আট বছর বয়সেই জয়বায়ু পরিবর্তনের কুফল সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। তবে এটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ১১ বছর বয়স থেকে। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। যখনই তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় সম্পর্কে জানতে পারেন তখনই তিনি কথা বলা কমিয়ে দেন, কমিয়ে দেন খাওয়াদাওয়াও। মাত্র দুই মাসে ছোট মেয়েটির ওজন কমে যায় ১০ কিলো। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। অন্য কয়েকটি শারীরবৃত্তীয় সমস্যার মতো ‘সিলেকটিভ মিউটিজম’ নামে একটি অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারও তাঁকে পেয়ে বসে।

২০১৮ সালে তাঁর বয়স যখন ১৫ তখন তিনি কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘শুক্রবার স্কুলে না গিয়ে’ প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে। এখানে জেনে নেওয়া ভালো ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’ বা ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ (এফএফএফ) একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন যাতে স্কুল শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকেন। এর পর তিনি ঘোষণা করেন—তিনি তখন পর্যন্ত তাঁর এই শুক্রবার স্কুলে না যাওয়া চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ না সুইডেন সরকার প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সম্মতি না দেবে।

আর এভাবেই স্টকহোমের ছোট্ট মেয়েটি পরিণত হন এক গ্লোবাল আইকনে।

সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাটি একটু ভিন্ন। গত ১ জুন ইতালির সিসিলির কাতানিয়া শহর থেকে ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলিন’ যাত্রা শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল দীর্ঘদিন ধরে মানবিক সংকটে থাকা গাজায় জরুরি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। ইসরায়েল গত ২ মার্চ থেকে গাজায় সবধরনের ত্রাণ প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। ফলে কয়েকটি শিশু অনাহারে মারা যায় বলে বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে।

ত্রাণবাহী জাহাজটি গাজার প্রথম ও একমাত্র নারী মৎস্যজীবী ম্যাডলিন কুলাবের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন দাবি করে, জাহাজটিতে রয়েছে গাজার মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, ময়দা, চাল, শিশুদের দুধ, ডায়াপার, নারীদের স্যানিটারি পণ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ কিট, ক্রাচ ও কৃত্রিম অঙ্গ।

জাহাজটিতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু আন্দোলনের নেতৃত্বেদানকারী ২২ বছর বয়সী সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ছাড়াও আরো আছেন ফরাসি চিকিৎসক ও অধিকারকর্মী বাপতিস্ত আন্দ্রে, আল-জাজিরার সাংবাদিক ওমর ফায়াদ, ব্রাজিলিয়ান কর্মী ও ফ্রিডম ফ্লোটিলা ব্রাজিলের সমন্বয়ক থিয়াগো অ্যাভিলা, ফরাসি-ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গ্রিন পার্টির এমইপি রিমা হাসান, তুর্কি মানবাধিকারকর্মী সুয়াইব ওর্দু। এছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের আরো কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সমুদ্র সংরক্ষণকর্মী আছেন জাহাজটিতে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, গাজার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের এমন বাধা ও মানবিক ত্রাণ আটকে দেওয়াকে ‘অমানবিক’ বলেও অভিহিত করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।

ইসরায়েল কর্তৃক আটককৃত জাহাজ ম্যাডলিন থেকে একটি রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তা পাঠান গ্রেটা থুনবার্গ। জানান, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি বাহিনী তাদের জাহাজ আটকে দিয়েছে। তিনি একে ‘অপহরণ’ বলে অভিহিত করেন এবং দ্রুত মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করেন।

গ্রেটা বলেন, ‘আমার নাম গ্রেটা থুনবার্গ, আমি সুইডেন থেকে এসেছি। আন্তর্জাতিক জলসীমায় আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী কিংবা ইসরায়েলকে সমর্থন জোগানো বাহিনী আমাদের অপহরণ করেছে।’

ভিডিওতে গ্রেটা তার বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা সুইডিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাঁর ও তাঁর সহযাত্রীদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত—গ্রেটা ও তাঁর সহযোগীদের আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ত্রাণবাহী জাহাজটিকেও আটক করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

গ্রেটা কী পারবেন এই আটকাবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে? মুক্ত করতে পারবেন তাঁর সাথীদের। ত্রাণবাহী জাহাজটিকে মুক্ত করে সেই ত্রাণ কী পৌঁছাতে পারবেন বুভুক্ষু-অসহায় গাজাবাসীর কাছে? যেই মেয়েটি একা প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বদলে দিয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্ববাসীর ধারণা। যাঁর একা দাঁড়িয়ে থাকার জেদের ফল হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে সমন্বয় করেন এমনই একটি প্রতিবাদ যাতে অংশ নেন কোটি শিক্ষার্থী। তিনি হেরে যাবেন—এমনটা না ভাবাই ভালো।

তবুও গ্রেটার প্রতিপক্ষ এবার দানব ইসরায়েল। যারা প্রতিনিয়ত বর্বর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে চলেছে ফিলিস্তিজুড়ে। যেখানে নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। যাদের পাশবিকতা পশুত্বের সব ইতিহাসকে মলিন করেছে। তাদের সাথে কী পেরে উঠবেন ২২ বছরের গ্রেটা?

শেষ পর্যন্ত এ লাড়াইটা কী জিততে পারবেন গ্রেটা? তাঁর প্রতিপক্ষ এক অসুরশক্তি। তবুও আমাদের প্রার্থনা—জিতে যাবেন গ্রেটা থুনবার্গ। বন্ধুদের মুক্ত করে আটকে রাখা ত্রাণবাহী জাহাজ নিয়ে ঠিকই পৌঁছে যাবেন গাজায়। যেখানে অপেক্ষা করছে হাজারো ক্ষুধার্ত মুখ, মলিন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x