১ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৫, ১:২২ এএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

চট্টগ্রাম: যে শহরে নালায় পড়ে হারিয়ে যায় মানুষ

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৫, ১:২২ এএম
চাটগাঁইয়ারাও কী এবার আমাকে ব্লক করে দেবেন?

চট্টগ্রাম বলতে আমি শুধু একটা কথাই বুঝি আর তা হলো- আমি বাঙালি নই, চাটগাঁইয়া। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক সাংসদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা) চৌধুরী দম্ভভরে আদালতে নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যদানকালে একথা বলেছিলেন।

নিজের পক্ষে সপ্তম দিনের মতো (দিনটি রবিবার ছিল) সাফাই সাক্ষ্যদানকালে এ মন্তব্য করেছিলেন তিনি। আগের ছয় দিনের মতোই ইংরেজিতে সাক্ষ্য দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাকে সোমবারের মধ্যে সাফাই সাক্ষ্য শেষ করার আদেশ দিয়েছিলেন।

পরে সাকা চৌধুরী বলেন, আমি এখন পর্যন্ত যে বক্তব্য দিয়েছি তা সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার বক্তব্য। কিন্তু তা রেকর্ড (কম্পিউটারে কম্পোজ) করতে অনেক বেশি সময় লাগছে। এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাকে বলেন, আপনি বাংলায় সাক্ষ্য দিলে এত সময় লাগত না। তার চেয়েও বেশি কথা বলতে পারতেন। জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, আমি বাংলায় সাক্ষ্য দিতে পারব না, ইংরেজিতেই দেব। কারণ, আমি বাঙালি না, চাটগাঁইয়া। বাংলায়তো আমি ভালো বলতে পারতাম না। টেকনিক্যাল প্রবলেম হতো।

ইন ফ্যাক্ট সাকা চৌধুরীকে এই লেখায় ডেকে আনার কারণ আর কিছুই না- সারাদেশের সব জেলার লোককে বইঙ্গা-ভইঙ্গা-বৈঙ্গা বলা আর ‘হাড্ডি কখনো গোস্ত হয় না, ভইঙ্গা কখনো দোস্ত হয় না’ বলে মজা নিয়ে নিজেদের এলিট ভাবা চট্টগ্রামবাসীর এখন কী অবস্থা তা একটু খতিয়ে দেখা। যদিও জানি, চাটগাইঁয়ারা আমাকেও ‘বইঙ্গা’ ভেবে এলেখাটি এড়িয়ে যাবেন।

চট্টগ্রাম নিয়ে কথা বলতে আমি বরাবরই একট বিব্রত বোধ করি। কেননা আমি অনেক আগেই ড. আহমদ শরীফ রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ পড়ে ফেলেছিলাম। কতটা সমৃদ্ধ আমাদের চট্টগ্রাম তা ভেবে অবাক হয়েছিলাম।

চট্টগ্রাম যাওয়া, থাকা বা ভ্রমণ করার সুযোগ আমার খুব একটা হয়নি তবে যতবার হয়েছে প্রতিবারই ছিল নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা। আমার চট্টগ্রমের বেশকিছু বন্ধু আছেন যাঁদের আমি এড়িয়ে চলি। ওই একটাই কারণ- এলিট ভাব। তখনই মনে পড়ে; আরে উনি তো বাঙালি না, চাটগাঁইয়া।

পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ জোয়াও ডি ব্যারোস-এর ‘বাংলা রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং ধনী শহর’টি এখন সামান্য বৃষ্টিতেই জলমগ্ন, জলাবদ্ধ। উন্নয়নহীনতা আর উন্নয়ন না করার ইচ্ছার রোষানলে এক শ্রীহীন মহানগর। এ শহরের নগরপিতারা আসলে নাগরপিতা মানে নাগর বা প্রেমিকের পিতা, সব সময় কটমট করে তাকিয়ে থাকে। শহরের কিছুই তার ভালো লাগে না। তিনি মসনদে বসেন শুধু ক্ষমতার পালকে মুখ ঘষে আনন্দ নেওয়ার জন্য।

চট্টগ্রামেরও উন্নতি হয়। পুরনো বাস নতুন করে রঙ করা হয়। ভাঙা ফুটপাতে নতুন করে ইট বসে। পার্কে অযত্নে মরে যাওয়া গাছ কেটে সেখানে নতুন গাছ লাগানো হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোর ভাড়া বাড়ে। নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল সে শহরে, সে শহরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ায় প্রাচ্যের টেসলা।

আর বৃষ্টি হলেই সংখ্যা বাড়ে। ‘নালায় পড়ে মৃত্যু’র শহর চট্টগ্রামে প্রাণ যায় শিশু-কিশোর-তরুণের। এ শহুরে উন্নয়ন নালার জলে ডুবে যায়।

বুধবার (০৯ জুলাই) দুপুর ৩টা। চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে নালায় পড়ে মরিয়ম নামে তিন বছর বয়সী এক শিশু মারা গেল (মারা গেল না বলে মেরে ফেলা হলো বলাই ভালো)। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

জানা যায়, হালিশহরের আনন্দপুর এলাকায় শিশুটির বাড়ি। সে বাড়ির পাশের একটি দোকানে যাচ্ছিল। পথে একটি নালার স্ল্যাব ছিল না এবং এর ওপরে পানি জমে ছিল। ফলে সেখানে নালা আছে সেটি বোঝার উপায় নেই। অসাবধানতাবশত শিশুটি সেখানে পা রাখলে নিচে পড়ে যায় এবং পানির স্রোতে ভেসে যায়। প্রথমে স্থানীয়রা এবং পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উদ্ধার অভিযান চালায়।

লক্ষ করুন- মৃত্যু কতটা কাছে এই নালার শহরে। বাড়ির পাশে দোকানে যাওয়ার পথে নালার স্ল্যাব ছিল না, বৃষ্টির পানি নালা ওভারফ্লো হওয়ায় বোঝা যাচ্ছিল না যে ওখানে একটা নালা আছে। শিশুটি সেই মৃত্যুকূপে পা রাখে এবং চিরতরে হারিয়ে যায়।

এঘটনা আজ নতুন নয়। এটা ভীষণ কমন প্র্যাকটিস- এই শহরের। এর আগে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এত মানুষের শহর, এত কর্মকর্তার শহর, এত বড় মেট্রোপলিটন কিন্তু নালার ওপর স্ল্যাব আছে কিনা সেই খোঁজ কেউ রাখেনি।

আসলে দুয়েকটা মানুষ নালায় পড়ে মরলে এই এলিট শহর চট্টগ্রামের কিছুই যায়-আসে না। সো লেট দেম ড্রোন অ্যাট দ্য নালা।

বৃষ্টি হোক বা না হোক এলিট শহর চট্টগ্রামে নালায় পড়া কিন্তু অবধারিত। এবছরের ১৮ এপ্রিল রিকশা থেকে ছিটকে উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় দুই নারী ও তাদের সঙ্গে থাকা ছয় মাস বয়সী এক শিশু। স্থানীয়দের সহায়তায় দুই নারীকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করা হলেও পানির স্রোতে শিশুটি তলিয়ে যায়। পরদিন চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এর আগে, ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। দীর্ঘদিন উদ্ধার অভিযান চালানো হলেও তার মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়া উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা যান!

২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু কামাল। তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ায় উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৭ ঘণ্টার চেষ্টার পর উদ্ধার হয় তার মরদেহ।

মনে আছে একদিন ফেসবুক- এক নারী পোস্ট দিলেন– ‘ভালোবাসা কাদায়’। আমি ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে গিয়ে লিখলাম- ম্যাডাম কা-এর ওপর একটা চন্দ্রবিন্দু দিন, নাহলে ভালোবাসা সত্যি সত্যিই কাদায় পড়ে যাবে। একটু পরই তিনি আমাকে ব্লক করে দিলেন।

চাটগাঁইয়াদেরও বলছি, শুধু আপ্যায়ন করে অন্যদের খাওয়ালে আর ঘন ঘন মেজবান খেলেই হবে না- উন্মুক্ত নালাগুলোর বুকেও স্ল্যাব বসাতে হবে। নাহলে এই এলিট চাটগাঁ পুরোটাই একদিন নালায় পড়ে যাবে।

চাটগাঁইয়ারাও কী এবার আমাকে ব্লক করে দেবেন?

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x