বিকাল থেকেই ঘরের পাশের বন্যা রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল মুহুরী নদীর পানি। এলাকার সবাই মিলে নদীরক্ষা বাঁধের ওপর বিভিন্ন ধরনের বস্তা দিয়ে পানি গড়ানো বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। পুরো বিকাল ভাঙন রোধের যুদ্ধের পর সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখি আমার ঘরের পাশেই বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে মা, স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয়ে রেখে আসি। সন্ধ্যার মাঝেই বাঁধভাঙা পানির তীব্র চাপে ঘরের একটি অংশ ভেঙে তলিয়ে যায়। একে একে ঘরের দেয়াল, পিলারসহ ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখেছি। স্বপ্নের ঘর পানির তোড়ে ভেসে যেতে থাকলেও দেখে দেখে কান্নাকাটি করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার।
আজ বুধবার (০৯ জুলাই) বিকেলে এসব কথা বলছিলেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর পূর্বপাড়া গ্রামের খন্দকার বাড়ির আলী আশরাফ। মুহুরী নদীর পানির চাপে তার নবনির্মিত আধাপাকা ঘরটি বিলীন হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়াও ফেনী পৌরসভার শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক এখন পর্যন্ত হাটু পরিমাণ পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে এবং শহরের বিভিন্ন পাড়ার সড়ক, অলিতে-গলিতেও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বুধবার বিকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে ফেনীর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ ও নদীতে পানির পরিমাণ কমলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙায় লোকালয়ে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী, কহুয়া ও ছিলোনিয়া নদী রক্ষা বাঁধের ১৫টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে দুই উপজেলায় ২৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং আরো নতুন নতুন বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হতে শুরু করেছে। বেড়িবাঁধের পরশুরামের ১০টি স্থানে এবং ফুলগাজী উপজেলা ৫টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও দুই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। প্লাবিত গ্রামসমূহের মধ্যে পরশুরাম উপজেলায় ১৫টি ও ফুলগাজী উপজেলায় ১২টি গ্রাম রয়েছে। প্লাবিত এসব গ্রামের পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফেনী-পরশুরাম অঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্লাবিত গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।

পরশুরামের পশ্চিম অলকা গ্রামের আবুল হাসেম জানান, ২৪ এর বন্যায় আমাদের এলাকায় ব্যাপক ক্ষতির পর আমরা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনি। এর মাঝেই আবার বন্যার কবলে পড়েছি। বাড়ির সামনের পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, বীজতলা তলিয়ে গেছে। ঘরে পানি ঢুকে গেছে। বাড়িঘর ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছে। সর্বস্ব হারাতে বসেছি। আমরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্থায়ী সমাধান চাই।
ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, মুহুরী ও কহুয়া নদীর ১৫টি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এখনো নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করলেও বাঁধভাঙা পানির চাপে লোকালয়ে পানি বাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে ফেনীর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, বুধবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জেলায় ভারী বৃষ্টি কমলেও বুধবার দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলার একাংশে ইতিমধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে দেড় হাজার জন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। তাদের খাবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। পরশুরাম উপজেলা ৯৯, ফুলগাজী উপজেলায় ৩২ এবং ফেনী সদর উপজেলায় ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় ২৫৩৭ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও স্বেচ্ছাসেবকরা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। জেলায় ইতিমধ্যে ত্রাণ কাজের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জেলায় ১২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ফুলগাজী ও পরশুরামে ইতিমধ্যে ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবারের প্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২৪ সালের আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ২৯ জনের প্রাণহানিসহ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার ফুলগাজী পরশুরামে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তার বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়নি।