প্রতিদিন ভোরে যখন কাবুলের শুষ্ক পাহাড়ে সূর্য উঁকি দেয়, তখন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী পরিবারগুলো ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এরপর তাদের প্রথম কাজ হয়, পানির সন্ধান করা। সম্প্রতি এক বালতি পানি পাওয়া যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
আফগানিস্তানের রাজধানীতে পানির তীব্র সংকট। ইদানিং রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে পাড়ায় পাড়ায় পানির ট্যাঙ্কার আসে। যখনই ট্যাঙ্কারের শব্দ কানে আসে, চার সন্তানের মা ৪২ বছর বয়সি রাহেলা কয়েকটা বালতি আর পাত্র নিয়ে দৌড়ে রাস্তায় চলে যান। ট্যাঙ্কার থেকে সেই বালতি ও পাত্রগুলো ভরে দেয়া হয়।
রাহেলার পরিবারে যতটুকু পানির প্রয়োজন, ততটুকু পাওয়া যায় না। এরপরও যতটুকু পাওয়া যায়, তা খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। রাহেলা জানান, পরিবারে পানি সরবরাহ সবসময় কম থাকে এবং প্রতি লিটার পানি অনেক দামি। তিনি বলেন, ‘আমরা পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছি না। এটা এত বড় সমস্যা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে।’
কাবুল আস্তে আস্তে ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে, যার ফলে কাবুল খুব শিগগিরই আধুনিক ইতিহাসের প্রথম পানিশূন্য রাজধানী হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছে অলাভজনক সংস্থা মার্সি কর্পস। এই সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন মতে, প্রায় ৬০ লাখের বেশি মানুষের শহর কাবুলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই পানি ফুরিয়ে যেতে পারে এবং এই সংকট অর্থনৈতিক পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট এবং মাটির নিচ থেকে অবিরাম অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে গত দশকে কাবুলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫-৩০ মিটার নিচে নেমে গেছে এবং শহরের প্রায় অর্ধেক ভূগর্ভস্থ বোরওয়েল বা কূপ ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে।
আফগানিস্তানের রাজধানীর একটি বিশাল অংশ ভূগর্ভস্থ বোরওয়েল খননের ওপর নির্ভরশীল। পানির স্তর কমে যাওয়ায় মানুষ পানির উৎস খুঁজতে আরও গভীরে বা বিভিন্ন স্থানে খনন করছে। জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদফতরের ২০২৪ সালের আগস্টের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার খনন করা কূপ রয়েছে।
মার্সি কর্পসের প্রতিবেদন অনুসারে, কাবুলে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার অনিয়ন্ত্রিত বোরওয়েল আছে বলে অনুমান করা হয়। ২০২৩ সালের জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাবুলের প্রায় ৪৯ শতাংশ বোরওয়েল শুকিয়ে গেছে। বাকিগুলো মাত্র ৬০ শতাংশ কার্যক্ষমতায় চলছে।
শহরটিতে বছরে ৪ কোটি ৪০ লাখ ঘনমিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, যা প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির নিচে পানি জমা হওয়ার পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। যদি এই ধারা চলতে থাকে তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে কাবুলের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যেতে পারে, যা শহরের প্রায় ৩০ লাখ বাসিন্দাকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে।
২০০১ সালে কাবুলের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখেরও কম, যা এখন প্রায় ৬০ লাখে পৌঁছেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন দুই দশকের সামরিক আগ্রাসনও এই সংকটে ভূমিকা রেখেছে। এই হস্তক্ষেপের ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে ও অনেক মানুষ কাবুলে চলে আসতে বাধ্য হয়, যা শহরের সম্পদের ওপর চাপ বাড়ায়।
আফগানিস্তান পানি ও পরিবেশ পেশাদার নেটওয়ার্কের সদস্য নাজিবুল্লাহ সাদিদ অবশ্য বলেন, রাজধানী শহর কখন পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। তবে কাবুলের পানির সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর। তিনি বলেন, আমরা জানি যে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর পানির ধারণক্ষমতাও কমতে থাকে— ভূগর্ভস্থ পানিকে একটি ক্ষয়প্রাপ্ত জলাধার হিসেবে কল্পনা করুন। তিনি আরও যোগ করেন, আমরা জানি যে শেষটা কাছে।