১ আগস্ট ২০২৫ শুক্রবার
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ৮:৪৩ পিএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী আব্দুল্লাহ এখন বামপন্থার প্রতীক

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ৮:৪৩ পিএম

ফ্রান্সের কারাগারে ৪১ বছর বন্দি জীবন কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী জর্জ আব্দুল্লাহ। ৭৪ বছর বয়সী লেবানিজ শিক্ষক আব্দুল্লাহ এখন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘বামপন্থি প্রতীক’ হয়ে উঠেছেন। শুক্রবার (২৫ জুলাই) ফ্রান্স তাকে মুক্তি দিয়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তির পর তার আইনজীবী বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘাত সংশ্লিষ্ট ঘটনার জেরে আব্দুল্লাহ দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি ছিলেন। শুক্রবার সকালে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলের একটি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই আব্দুল্লাহকে সরাসরি বিমানে করে লেবাননে বৈরুতে পাঠানো হয়।

আব্দুল্লাহকে জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সে দুই কূটনীতিককে হত্যার অভিযোগে আব্দুল্লাহ দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ওই দুই কূটনীতিকের মধ্যে একজন আমেরিকান, অন্যজন ইসরায়েলি। শুরুর দিকে তাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা হলেও, ধীরে ধীরে তার কথা ভুলতে বসেছিল লোকজন। বিশেষ করে বামপন্থিরা। কিন্তু তার এ মুক্তি মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী বামপন্থিদের জন্য এক স্মরণীয় ঘটনা হয়ে ধরা দিয়েছে এবং তিনি যে পুরোপুরি বিস্মৃত হননি তা-ই সামনে নিয়ে এলো।

আগে প্রায়ই বামপন্থিদের বিক্ষোভ মিছিলের ব্যানারে দাঁড়িভর্তি অবিচল মুখাবয়ব ভেসে উঠতো। বছরে অন্তত একবার বিক্ষোভকারীরা তাকে রাখা ফ্রান্সের পিরিনিস কারাগারের সামনে তার মুক্তির জন্য বিক্ষোভ করতেন। বামদের নেতৃত্বাধীন ফান্সের ৩টি পৌর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘সম্মানসূচক নাগরিক’ ঘোষণা করেছে। ১৯৯৯ সালের পর থেকেই তিনি প্যারোলে মুক্তি পেতে পারতেন। কিন্তু তার মুক্তির আবেদনগুলো বারবার খারিজ হয়ে যায়। আর এর কারণ হিসেবে তার সমর্থকরা বলছেন, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই ফ্রান্স সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি।

আব্দুল্লাহ ১৯৫১ সালে উত্তর লেবাননে এক খ্রিস্টান পরিবারের জন্ম নেন। গেল শতাব্দীর ’৭০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি লেবানিজ আর্মড লেভল্যুশনারি ফ্যাকশসন (এলএআরএফ) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। মাকর্সবাদী ছোট এ গোষ্ঠীটি ইসরায়েল এবং তার মিত্র আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক ওই সময় লেবাননে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে এবং পুনরায় ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনপন্থি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ করে।

সেসময় আব্দুল্লাহর প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীটি ইউরোপে থাকা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ফ্রান্সে তেমন ৫টি আক্রমণ চালায়। ১৯৮২ সালে গোষ্ঠীটির সদস্যরা স্টার্সবার্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক চালর্স রয় এবং প্যারিসে ইসরায়েলি কূটনীতিক ইয়াকুভ বারসিমান্তভকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়াও একটি গাড়ি বোমা হামলায় ফরাসি দুই বোমা নিষ্ক্রিয়কারী বিশেষজ্ঞকে হত্যার দাবি করে এলএআরএফ।

১৯৮৪ সালে লিয়ন থেকে আব্দুল্লাহ গ্রেপ্তার হন। প্রকৃতপক্ষে, ফরাসি গোয়েন্দারা তাকে পাকড়াও করছিল। তিনি ভেবেছিলেন তাকে ইসরায়েলি ঘাতকরা অনুসরণ করছে। তাই তিনি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে কেবল জাল পাসপোর্ট এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

তার কিছুদিন পর উত্তর লেবাননে এক ফরাসি নাগরিক অপহৃত হন। তখন ফরাসি গোয়েন্দারা আল জেরিয়ার মাধ্যমে আব্দুল্লাহর মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের নাগরিককে ফেরাতে আলোচনা শুরু করে। আলোচনার একপর্যায়ে ফরাসি ওই নাগরিক মুক্তি পান। কিন্তু আব্দুল্লাহ মুক্তি পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে প্যারিসের পুলিশ তার ফ্ল্যাটে অস্ত্রের মজুত পাওয়ার কথা বলে। ওই অস্ত্রের মধ্যে কূটনীতিকদের হত্যা করা পিস্তলও ছিল। আর ওই অস্ত্রই তার মুক্তিকে অসম্ভব কর তুলে। এখানেই শেষ নয়, দুই বছর পর তার বিচার শুরুর আগে আগে প্যারিসে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে।

এতে ১৩ জন নিহত হয়। ফ্রান্সের রাজনীতিবিদ এবং সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার জন্য আব্দুল্লাহর সহযোগীদের দায়ী করে। তাদের অভিযোগ ছিল, আব্দুল্লাহকে মুক্তি দিতে ফ্রান্সের ওপর চাপ তৈরি করতেই তার সহযোগীরা ওই হামলাগুলো করেছে। যদিও পরবর্তীতে দেখা যায়, সেই হামলাগুলো ইরানের ইন্ধনে লেবাননভিতিক শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ চালিয়েছিল। এদিকে, বিচারে আব্দুল্লাহ কূটনীতিকদের হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেও হামলাকারীদের পক্ষে কথা বলেন। পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।

১৯৯৯ সালের পর থেকে অন্তত ১০ বার মুক্তির আবেদন করেন আব্দুল্লাহ। যদিও মাত্র একবার তার আবেদন গ্রহণের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু তার মুক্তির আগে ২০১৩ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফ্রান্স সরকারকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি আব্দুল্লাহকে মুক্তি দিতে আদালতের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জে ফ্রান্স সরকার কোনো পথ বের করবে বলে আশা প্রকাশ করেন। আর উইকিলিকস ফাঁস করার পর ফ্রান্সকে দেওয়া হিলারির ওই বার্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

ওই চিঠির পর ফ্রান্সের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস আব্দুল্লাহকে দেশে পাঠানোর (বিনিময় শর্ত) আনুষ্ঠানিক নির্দেশেনায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। আর এতেই আটকে যায় আব্দুল্লাহর মুক্তি। চলতি বছর ফ্রান্সের আপিল আদালত নতুন সিদ্ধান্ত দেয়। আদালত জানায়, আব্দুল্লাহর দণ্ডকালের সময় (লেন্থ) সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তিনি আর এখন হুমকি নন। এবারও আদালত বলেছে, মুক্তির পরপরই তাকে ফ্রান্স থেকে বের করে দিতে হবে।

আব্দুল্লাহর আহনজীবী জ্যঁ লুইস চালাসেট বলেছেন, ন্যায়বিচারের জয় হয়েছে। তবে এটা একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যে, আগে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে তাদের আচরণের জন্য ধন্যবাদ। আব্দুল্লাহর মুক্তির জন্য প্রচারণা চালানো ব্যক্তিদের মধ্যে ২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া অ্যানি এরনাক্সও ছিলেন। অ্যানি বলেছেন, তিনি (আব্দুল্লাহ) রাষ্ট্রীয় বিচারের ভুক্তভোগী। এই জন্য ফ্রান্সের লজ্জিত হওয়া উচিত।

১৯৮৫ সালে অপহৃত সেই ফরাসি নাগরিকের বিনিময়ে আব্দুল্লাহর মুক্তি আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন ফ্রান্সের গোয়েন্দা প্রধান ইয়ভেস বোনেট। তিনি এখন দেশটির অতি ডানপন্থি ন্যাশনাল র্যালির সদস্য। বোনেট বলেন, তার (আব্দুল্লাহ) সঙ্গে একজন সিরিয়াল কিলারের চেয়েও খারাপ আচরণ করা হয়েছে। তাকে জেলে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া ছিল। ফরাসি পত্রিকা লা মন্ডে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত কোনো ফিলিস্তিনি বন্দিও ৪০ বছরের বেশি কারাজীবন কাটাননি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ৪১ বছর বন্দি ছিলেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x