জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং সিনেট চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেছেন, আধুনিক শিক্ষা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে না। ব্যবহারিক দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে। আধুনিক শিক্ষার ধারা পরীক্ষামূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো, শিক্ষার্থীদের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বকে থাকার জন্য প্রস্তুত করা।
জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আর শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন সাধনের জন্য প্রথমেই আমাদের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাকে কেবল ডিগ্রি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে কখনো জাতির উন্নতি হবে না। মানহীন ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষা জাতিকে উন্নত সমৃদ্ধ করতে পারে না।
আজ শনিবার (২৮ জুন) বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সিনেট হলে ২৭তম সিনেট অধিবেশনে বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ভিসি আরো বলেন, ৩৬ জুলাই বিপ্লবের অকুতোভয়ের শহীদদের পরিবারকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তাদের নামে স্মৃতিফলক নির্মাণ, ভবনের নামকরণ ও শিক্ষাবৃত্তি চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ সুবিধা সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষা এমন একটি শক্তি যার যথাযথ প্রয়োগে একটা দুর্বল পশ্চাৎপদ দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও বদলে যেতে পারে। যে দেশ বিশ্বের দরবারে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, বুঝতে হবে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত হাজির হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। জাতি হিসেবে নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মানুষ হওয়ার জন্য সাধনা, স্বদেশের মঙ্গল কামনা ও ব্যক্তির আত্মশক্তির বিকাশ প্রভৃতি দিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। পরীক্ষায় চাপে পিষ্ট এবং চাকরির প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বিদ্যার্থীদের ক্রমাগত করে তুলছে জীবনীশক্তিশূন্য ও হতাশাগ্রস্ত। আমাদের শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা হওয়া উচিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণ, চিন্তাশক্তির স্ফূরণ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক চেতনাবোধ এবং স্বকীয় চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।
শিক্ষকদের উদ্দেশে ভিসি তার বক্তব্য বলেন, জ্ঞাননির্ভর ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রচলিত পঠন-পাঠন তাদের আকৃষ্ট করে না। শিক্ষকদের কাছ থেকে তারা শুনতে চায় নতুন দিনের নতুন কথা। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের শিক্ষা মনস্তত্ব ও পাঠদানকৌশল রপ্ত করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন প্রকৃত শিক্ষক কঠিন কোনো বিষয়কে এতটাই সহজ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরবেন যাতে করে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তাদের জড়তা দূর হয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার যে ধারা বিরাজ করছে তা মোটেও সুখকর নয়। শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা অর্জনের চেয়ে গণপতি একটা ডিগ্রি অর্জন বা সার্টিফিকেট পাওয়ার দিকে ঝুঁকছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো মানের শিক্ষক নেই বলে তারা কর্মজীবনের সফলতা পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এবং কলেজ শিক্ষকদের অধিকাংশেরই পিএইচডি ডিগ্রি নেই। ফলে মানসম্মত শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম যুগোপযোগী নয়। আমাদের দেশের শিক্ষকগণ যথেষ্ট মর্যাদা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা আজ অবহেলিত। তারা বেতনবৈষম্যেরও শিকার।
বিভিন্ন দেশের বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে জাতীয় বেতন স্কেলের শুধুমাত্র মূল বেতন পেয়ে থাকেন। ফলে তাদের মানবতার জীবন যাপন করতে হয়। এতে এসব শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজ করে চরম হতাশা।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নেই এবং গবেষণা সুবিধাও সীমিত। উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রযুক্তি সফট স্কিল এবং গবেষণাপদ্ধতির ঘাটতিও প্রকট। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার অন্যতম কারণ শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রের বাজেটের অপ্রতুলতা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও পেশাগত যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ কলেজের যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে আসছে। পাশাপাশি অন ক্যাম্পাস শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায় ৪টি বিষয়ে স্নাতক-সম্মান কোর্স চালু রয়েছে। চলতি শিক্ষা বর্ষ থেকে আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, ১৫টি বিষয়ে অ্যাডভান্স মাস্টার্স, ৩১টি বিষয়ে এমফিল পিএইচডি, ১২টি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। খুব শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে আরো ১২টি শর্ট কোর্স যুক্ত হতে যাচ্ছে।
উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে নানা সমস্যা। সমস্যাগুলোর মধ্যে ডিগ্রি (পাস), অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষকের অভাব রয়েছে।