সিলেট অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে, যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চাপও বেড়েছে বহুগুণে। আর এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু ও সড়ক নির্মাণ করেছে, যেখানে টোল আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফেরা নিশ্চিত করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এই টোল প্লাজাগুলো এখন দুর্নীতি, অনিয়ম আর প্রভাবশালীদের স্বার্থরক্ষার একটি ‘হটস্পটে’পরিণত হয়েছে। রসিদ ছাড়া টোল আদায়, কোটি টাকার খাস কালেকশন গায়েব, টাকার হিসাব না মেলানো এবং বছরের পর বছর টেন্ডার ঝুলিয়ে রাখার মতো চিত্র এখন সিলেটের টোল ব্যবস্থাপনার নিত্যচিত্র।
সিলেট বিভাগের ছয়টি টোল প্লাজার মধ্যে তিনটি—শেরপুর সেতু, শাহপরাণ বাইপাস সেতু এবং ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা নদীর সেতু, আগে পরিচালনা করত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এটিটি’। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে এই তিনটির দায়িত্ব নেয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। বাকি তিনটি হলো, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রুস্তমপুর, রাণীগঞ্জ এবং ছাতক টোল প্লাজা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন শেরপুর থেকে আদায় হয় ৪–৫ লাখ টাকা, ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে দেড়–দুই লাখ, এবং শাহপরাণ সেতু থেকে প্রায় ১–১.৫ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে তার একটি অংশমাত্র। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন বা এক দিন পরপর আদায়কৃত টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা জমা দেওয়া হয় সপ্তাহখানেক পর বা তারও পরে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছোট যানবাহন বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশা থেকে রসিদ ছাড়াই টোল আদায় হয়। কোথাও কোথাও সফটওয়্যার থাকার পরও তা ব্যবহার করা হয় না। চলছে হাতে লেখা রশিদে আদান–প্রদান। টোল আদায়ের তথ্য হালনাগাদ না হওয়ায় অনেক টাকার কোনো রেকর্ডই থাকছে না। প্রশ্ন উঠছে—এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে? কারা পাচ্ছে এই অবৈধ আয়ের ভাগ?
এই অনিয়মের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, দুই বছরেও টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি সওজ। যদিও বলা হচ্ছে, সব কিছু ঠিক থাকলে টেন্ডার হবে, না হলে রি-টেন্ডার হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। এর পেছনে রয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের ভূয়া অভিজ্ঞতা সনদের জটিলতা।
মেসার্স মো. জামিল ইকবাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছয়টি টোল প্লাজার সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তারা যে অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়েছে, তা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। তারা দাবি করেছে, ২০২০–২০২৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) একটি ১২ কোটি টাকার প্রকল্পে কাজ করেছে। প্রকল্পটিতে উল্লেখ ছিল—সিলেট বাস টার্মিনাল ও ট্রাক টার্মিনালে স্বয়ংক্রিয় টোল আদায়, যানবাহনের ওজন পরিমাপ ব্যবস্থা, রিয়েল টাইম ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং AI-ভিত্তিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন।
কিন্তু প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়ে প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দেখতে পান—বাস্তবে এমন কোনো আধুনিক অবকাঠামোর অস্তিত্ব নেই। কিছু সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সেগুলো লাগানো হয়েছে ২০২৪ সালে, টেন্ডার জমা দেওয়ার সময়ের পরপরই। প্রকৌশলী নিজেই বলেন, “আমাদের দেখানো প্রকল্পের কাজ বাস্তবে নেই বললেই চলে, শুধুই কাগজে-কলমে একটি CSR প্রকল্প দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই সনদ কীভাবে যাচাই না করে গ্রহণ করা হলো? কেন এই ধরনের ভূয়া অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি সংস্থা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারল? সওজের ভেতরে থাকা একটি সুবিধাভোগী মহলকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে টোল ইজারা নিয়ে দুর্নীতির এ খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। দরপত্র ডাকা হলেও সময়ক্ষেপণ করে ইচ্ছেমতো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে মূল্যায়নে বিলম্ব করা হয়। প্রাক্কলিত দামের তুলনায় ৩০–৪০ শতাংশ কম দরদাতা এলেও তাকে কাজ না দিয়ে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা হয়, যাদের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা ঠিক থাকে আগেই।
সিলেটের বিশ্বনাথ, জকিগঞ্জ, ছাতকসহ আরও কয়েকটি এলাকায় একই ধাঁচের অনিয়ম দেখা গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অনিয়ম ঘটলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বরং টেন্ডার স্থগিত রেখে সংশ্লিষ্টদের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয় বারবার।
সরকারের ক্ষতি হচ্ছে শুধু আর্থিকভাবেই নয়, এর প্রভাব পড়ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নেও। টোল থেকে যে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা, তা দিয়েই মূলত সড়ক সংস্কার, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও টোল ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি যুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু সেই অর্থ লোপাট হওয়ায় উন্নয়নও থমকে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় সচেতন মহল বলছে—দ্রুত টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সঠিক ও অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে হবে। ভুয়া সনদদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে টেন্ডারে জমা দেওয়া অভিজ্ঞতা সনদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সরেজমিন যাচাই করতে হবে। শুধু নথিপত্রে নয়, বাস্তবিক কাজ হয়েছে কিনা তা প্রমাণ করতে হবে ভিডিও ও ডিজিটাল প্রমাণের মাধ্যমে।
সরকারি অর্থ সুরক্ষায় প্রতিটি টোল প্লাজার আদায় ও জমার হিসাব প্রতিদিন কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা মনিটরিং ইউনিট গঠন করার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আর যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব লোপাট হতে থাকবে, আর দুর্নীতির সিন্ডিকেট অদৃশ্য হাতের জোরে থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ব্যাপারে সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন এর বক্তব্য জানতে বার বার কল দিলে রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।