ছয় দশকের বেশি সময় ধরে পরিচয়হীন, অধিকারহীন জীবন কাটানো মানুষগুলো ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাতে এক নতুন সূর্যোদয় দেখেছিল। তারা রাষ্ট্র পেয়েছিল, নাগরিক পরিচয় পেয়েছিল, পেয়েছিল ভোটাধিকার। কিন্তু সেই মুক্তির দশ বছর পরও তাদের জীবন থেকে দুর্ভোগ পুরোপুরি মুছে যায়নি। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার মানুষ আজও একটি বেসিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করছেন তারা চান একটি পৃথক ইউনিয়ন।
২০১৫ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক অধ্যায় রচিত হয়। ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের সঙ্গে বিনিময় হয়। এই বিনিময়ের ফলে ছিটমহলবাসীরা পায় নাগরিক মর্যাদা, ভোটাধিকার, জমির মালিকানা এবং সরকারি সেবা গ্রহণের সুযোগ।
এই বিনিময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সবচেয়ে বড় ছিটমহল ছিল দাসিয়ার ছড়া, যার আয়তন ৬.৬৫ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ হেডকাউন্ট অনুযায়ী এখানে রয়েছে ১,৩৬৪টি পরিবার এবং ৬,৫২৯ জনের স্থায়ী বসবাস।
দাসিয়ার ছড়ার বর্তমান দুর্ভোগের মূল কারণ প্রশাসনিক বিভাজন। পুরো অঞ্চলটি ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর, ভাঙামোড় ও ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নাগরিক সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে স্থানীয়দের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক মো. নাসিরুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই একই গ্রামে থাকি, তবুও ছোট একটি কাজের জন্য এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে ছুটতে হয়। এক ইউনিয়নে বসবাস করলেও জন্মসনদ হয় আরেক ইউনিয়ন থেকে। এটা খুবই কষ্টদায়ক। কৃষক মো. জুয়েল বলেন, আমার বসতভিটার একটি অংশ পড়েছে ভাঙামোড় ইউনিয়নে, অন্যটি কাশিপুরে। জমির কাজ করতে হলে যেতে হয় কাশিপুরে। অথচ ইউনিয়ন পরিষদ সেখানে বেশ দূরে।
দাসিয়ার ছড়ায় গত দশ বছরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ, রাস্তা, স্কুল ভবন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, টিনের ঘরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ না থাকায় এলাকাবাসী সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছে না। নারী, বৃদ্ধ ও শিক্ষার্থীদেরও। স্বাস্থ্যসেবা, ভিজিডি-ভিজিএফ, জন্মনিবন্ধন, নাগরিক আবেদন, কৃষি সেবা সব কিছুর জন্য বিভিন্ন ইউনিয়নে দৌড়াতে হয়।
দাসিয়ার ছড়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির রয়েছে। এখানে মুসলিম ও হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছেন। কালিরহাট বাজারের এক পাশে মসজিদ, আরেক পাশে মন্দির। এমন বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কোনো ধর্মীয় বিভাজন নেই।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয়ক কমিটির দাসিয়ার ছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, “এই জনপদে হিন্দু-মুসলিম মিলে আমরা খুব ভালো আছি। কিন্তু ইউনিয়ন বিভাজনের কারণে আমরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের একটাই দাবি দাসিয়ার ছড়াকে স্বতন্ত্র ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হোক।”
দাসিয়ার ছড়াকে ইউনিয়নে উন্নীত করার বিষয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার ইউএনও রেহেনুমা তারান্নুম বলেন, এই বিষয়ে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। তবে এলাকাবাসীর দাবি, দীর্ঘদিন ধরে এই দাবির কথা বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে বলা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয় উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছেন, ছিটমহল বিনিময়ের সময় এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন গঠনের কথা ভাবা উচিত ছিল। এখনো সময় আছে তা সংশোধনের। ৬ হাজারের বেশি জনসংখ্যা, ৬ বর্গকিলোমিটারের বেশি আয়তন এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো সবকিছু বিচার করলে দাসিয়ার ছড়াকে পৃথক ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা একদম যৌক্তিক। এতে নাগরিক সেবা, স্থানীয় সরকার কাঠামো ও উন্নয়ন পরিকল্পনা আরও কার্যকর হবে।