২৫ জুন ২০২৫ বুধবার
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫, ৮:৫৫ পিএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

সিলেটে ঝুঁকিপূর্ণ টিলার পাদদেশে ১০ হাজার মানুষের বাস

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫, ৮:৫৫ পিএম


বৃষ্টিতে পাহাড়-টিলা ধসের মধ্যেও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। জেলায় পাঁচ বছরে টিলা ধসে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন। এরপরও কমছে না ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন। টিলায় বসবাস নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সংযোগ বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন।

গত ০১ জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে প্রাণ হারান একই পরিবারের চারজন। গত বছরও জুনে এভাবে নগরীর চামেলীবাগে মৃত্যু হয় স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের। গত ৫ বছরে টিলা ধসে এই এলাকায় প্রাণহানি ঘটে অন্তত ২০ জনের। প্রতিবছর টিলা ধসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও, বন্ধ হয়নি পাহাড় কেটে বাড়ি-ঘর তৈরি। বরং ঝুঁকির মধ্যেও বাড়ছে বসবাসকারীদের সংখ্যা।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এছাড়া সারাবছর তাদের তৎপরতা দেখা যায় না।

গত দেড় দশকে সিলেটে অন্তত ৬১টি টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে টিকে আছে মাত্র ৩৫১টি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সিলেটের তথ্যমতে, জেলার মধ্যে ৩৮৬টি পরিবারের এখনো বসবাস টিলার পাদদেশে মৃত্যুকূপে। যে কারণে প্রতিবছরই ঘটছে ‍দুর্ঘটনা। আর অঘটন ঘটলেই কেবল সতর্কতার হাঁকডাক পড়ে যায়। এমনি ঘটেছে এবারো সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষনাবন্দ ইউনিয়নে টিলা ধসে চার মুত্যুর পর।

জানা গেছে, মৃত্যুকূপে বসবাসকারীরা বৃষ্টি এলেই টিলার পাশে দিনযাপন করলেও রাত্রি কাটান অন্যের ঘরে। তাদের ধারণা দিনে টিলা ধসে পড়বে না, কিংবা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে পারবেন। বড়দের এই চিন্তাধারা থাকলেও ঝুঁকিতে থেকে যায় ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরা।

সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর টিলা ধসে নিহত হচ্ছেন তবু টিলার পাদেদেশে ঝুঁকিতে বসবাস থামছে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

সিলেটে কি পরিমাণ লোকজন পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করেন, সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই। কেবল পরিবারের হিসাব রয়েছে।

জানা গেছে, প্রভাবশালী চক্র টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পাদদেশে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় রাখেন। কম ভাড়া পেয়ে খুশিতে মৃত্যুকূপে বসবাস করেন অনেক পরিবার। পাশাপাশি টিলা কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। টানা বৃষ্টি হলেই সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের খবর পাওয়া যায়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলার পাদদেশে ৩৮৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করলেও তাদের সরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আজো পরিলক্ষিত হয়নি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ২৭৯টি পাহাড়-টিলার মধ্যে ১৬৯টি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকায় ৫ টিলার পাদদেশে ৭টি পরিবার, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭১টি টিলা ঘেঁষে ৮৮টি পরিবার, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৯টি টিলায় ৯টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলায় ১টি টিলায় ৩টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলার মোট ৭৫টি টিলার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলায় ৩টি পরিবার, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের ১২টি টিলায় ৩৮টি পরিবার, বিশ্বনাথ উপজেলার ১টি টিলায় ৬টি পরিবার, সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগরে ২৫টি টিলায় মোট ৭০টি পরিবার, খাদিমপাড়ায় ১৫টি টিলায় মোট ৩৯টি পরিবার, টুকেরবাজার ২০টি টিলায় ১২৫টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

অবশ্য সিলেটের জকিগঞ্জে ৯টি টিলা, গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলাসহ মোট ২৭টি টিলা রয়েছে। এগুলোতে জনবসতি নেই বলে জানা গেছে।

সিলেটে প্রতিবছর ভারি বৃষ্টিপাতে বিভিন্ন টিলা-পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায় এবং মাটি ধসে ছোট-বড় নান দুর্ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের ট্রাজেডির সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সিলেট বিভাগে টিলার মাটি ধসে অন্তত অর্ধশতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোর জন্য টিলা-পাহাড় কর্তনকেই মূলত দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা। এরপরও সিলেটে কিছুতেই বন্ধ হয় না পাহাড়-টিলা কাটা।

সিলেট মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলায় কয়েক বছর আগেও মানুষের তেমন আনাগোনা ছিল না কিন্তু এখন এই সকল সেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ঘনবসতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা, ব্রাহ্মণশাসন, জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরীর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার মানুষ।

সিলেট মহানগরীর ৬ নম্বর টুকেরবাজারের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বৃষ্টিতে টিলার পাদদেশে দিনে বসবাস করলেও রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যান। ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরাও এই মৃত্যুঝুঁকিতে দিন পার করছেন। বর্ষা মৌসুম আসার আগে কিংবা কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও প্রসাশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় না। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রসাশন থেকে মাইকিং করা হয় কিন্তু বর্ষা মৌসুম আসার আগে কোনো ধরনের নির্শেনা কিংবা কোনো ধরনের ঝুঁকি সংবলিত বিলবোর্ড টাঙানো হয় না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘সিলেটে নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলাধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’

পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ‘আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে। বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।’
অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘টিলা কাটার ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রত্যেক উপজেলাতেই টিলা কাটা হয়ে থাকে। প্রতিমাসেই এ অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। আমরা মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি। এর কারণে যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকে তাদের কোনোভাবেই যাতে ইউটিলিটি (বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহ) না দেওয়া হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x