ক্ষুধার কোনো পরিসংখ্যান নেই, ক্ষুধার্তেরও। যারা এই পরিসংখ্যান দিতে চান তারা ক্ষুধা ও ক্ষুধার্তদের নিয়ে ট্রেড বা ব্যবসা করতে চান। তবে যেকোনো দিক বিবেচনায় একটা ভয়াল পরিসংখ্যান কিন্তু আছে। প্রতিদিন ক্ষুধা এবং ক্ষুধাজনিত নানা কারণ ও অপুষ্টিতে পৃথিবীতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই শিশু। প্রতি চার সেকেন্ডে এক মৃত্যু।
পরিসংখ্যানটা সত্যিই ভয়াল, লোমহর্ষকও বটে। যাঁরা অন্তত দুবেলা খেতে পারছেন, তারা এই পৃথিবীর বুকে নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। আমিও ভাবি। কেননা, একমাত্র ক্ষুধাই মৃত্যুহীন, আপসহীন।
পৃথিবীতে একটা বাণিজ্য কিন্তু খুব রমরমা। এটাকে বলে হাঙ্গার ট্রেড, আপনি এটাকে ক্ষুধাবাণিজ্যও বলতে পারেন। আপনি কী ধারণা করতে পারেন পৃথিবীতে প্রতিবছর কত বিলিয়ন ডলারের ক্ষুধাবাণিজ্য হয়। শুনলে বিশ্বাস করবেন না। তাই ক্ষুধা নিয়ে ব্যবসার অঙ্ক না বলি।
আপনি যদি সারাজীবন ক্ষুধার গল্প বলেন, শেষ হবে না। ক্ষুধা অফুরান, ক্ষুধার গল্পও অশেষ। বিশ্বব্যাপী এই ক্ষুধা ও খাদ্যাভাবের চারটি প্রধান কারণ খুঁজে বের করেছেন বিশ্লেষকরা। এগুলো হলো—দারিদ্র্য, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্য। এগুলো আমরা সবই জানি। এটাও জানি যে এই ভয়াল ব্যাধি নিরাময়যোগ্য। আমরা এটাও জানি, এই পৃথিবীর সম্পদ যদি শতভাগ নয় মাত্র ১২ শতাংশ সুষম বণ্টন হয় তাহলে ক্ষুধা তো থাকবেই না, বরং মানুষ চারবেলা পেট পুরে খেতে পারবে।
আসলে ক্ষুধা বিশ্বমোড়লদের জিইয়ে রাখা এক জিওপলিটিক্সের নাম।
সম্প্রতি ক্ষুধা, খাদ্যাভাব এবং খাবার দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে হত্যার এক আশ্চর্য চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই র্যাট-ট্র্যাপ বা ইঁদুর ধরার ফাঁদ দেখেছেন। খাবারের লোভ দেখিয়ে ইঁদুরকে একটি ধাতব ফাঁদ বা খাঁচায় আটকানো হয়। তারপর ধরা পড়া ইঁদুরকে মেরে ফেলা হয়। এই ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। ক্ষুধার্ত মানুষদের খাবার দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর তারা ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে’ টাইপের বানোয়াট কথা বলে গুলি করা হয়, ড্রোন হামলা করা হয় এবং গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়।
ঘটনাটি কোথায় ঘটছে বুঝতে নিশ্চয়ই বাকি নেই কারো। হ্যাঁ, আমি গাজার সেই ভয়াবহ হাঙ্গার ট্র্যাপের কথা বলছি। যেখানে আজ পর্যন্ত খাবারের লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে ৭৪৩ জন ফিলিস্তিকে হত্যা করা হয়েছে। গত ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ৫১ জনকে হত্যা করা হয় এভাবেই।
সমালোচিত-বিতর্কিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই ‘সাহায্য সংস্থা’ গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) এবছরের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে। খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র অধিকৃত হাজা ভূখণ্ডে মানবিক সাহায্য বিতরণের নামে ত্রাণকেন্দ্র খুলে বসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এটিকে দেখভাল করে ইসরায়েল সরকার। মাসে ১৪০ মিলিয়ন ডলাল খরচের হিসেবে সংস্থাটি গত মে মাসের শেষ দিক থেকে গাজায় ত্রাণ বিতরণ শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গত কয়েক সপ্তাহে খাবার নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৭৪৩ ফিলিস্তিনি। এছাড়া আহত হয়েছেন আরো চার হাজার ৮৯১ জন। শনিবার (৫ জুলাই) এতথ্য জানায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ফলে ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে জিএইচএফ। একাধিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সংস্থাটির কর্মীদের পাশাপাশি ইসরায়েলি বাহিনীও ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর গুলি চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদ মাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এ সপ্তাহের শুরুতে ওই সংস্থায় কর্মরত বেশ কয়েকজন মার্কিন ভাড়াটে কর্মীর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানায়, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে সহায়তা নিতে আসা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি ও স্টান গ্রেনেড ছোড়া হয়। সেখানে অস্ত্রে সজ্জিত কর্মীরা যা খুশি তাই করে।
তবে জিএইচএফ এপির প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দেয়। বলে, তাদের কাছে নিজেদের কার্যক্রম স্থলগুলোর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাবার নিতে গিয়ে আহত হওয়া মজিদ আবু লাবান আল জাজিরাকে বলেন, আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওই (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলাম।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বহু মানবাধিকার সংস্থা জিএইচএফ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি একে ‘অমানবিক ও প্রাণঘাতী সামরিকীকৃত কর্মসূচি’ হিসেবে অভিহিত করে। এর আগে জুনের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসন জিএইচএফের জন্য ৩ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।
বহির্বিশ্ব থেকে গাজাকে বিচ্ছিন্ন করে, মানবিক করিডোর বন্ধ করে, ত্রাণ প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করে ইসরায়েল গাজাবাসীকে এবার না খাইয়ে মারতে চাইছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝেও থেমে নেই গাজায় হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংস-হত্যা-মৃত্যু-রক্ত যেন গাজার প্রতিমুহূর্তের ঘটনা।
এখন খাবারের জন্যও মরতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। জিএইচএফের ত্রাণ যেন মৃত্যুর বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। আমরা যাঁরা এখনো বেঁচে আছি এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে, তাঁদের জন্য বিষয়টি লজ্জার ও মর্মপীড়ার।