অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একদিনের ব্যবধানে আরও ১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ১৩ দলের নেতারা জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা চেয়েছেন। বুধবার (২৩ জুলাই) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় চলমান অস্থিরতা কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা ও পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠক রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেন- রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সৈয়দ হাসিবউদ্দিন হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির মজিবুর রহমান, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, গণ অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) রেদোয়ান আহমেদ, খেলাফত মজলিসের আহমদ আবদুল কাদের, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির তানিয়া রব, ১২–দলীয় জোটের শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণফোরামের মিজানুর রহমান।
বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরতে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হন নেতারা। প্রায় প্রত্যেকেই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অভিযোগ করেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতি বিশেষ নজর দিচ্ছে সরকার। ফলে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে। সরকার নিরপেক্ষতা হারালে সঠিক নির্বাচন সম্ভব নয় জানিয়ে তারা সবার প্রতি সমান আচরণেরও দাবি জানান।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের কারণে ফ্যাসিবাদ সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের বিভেদের পেছনে সরকারের দায় রয়েছে।’
নির্বাচনের আগে ঘন ঘন সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচন ঠিকভাবে হবে কি না, এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংশয় রয়েছে। এসব সরকারকেই দূর করতে হবে। সরকারের বিমাতা সুলভ আচরণ বন্ধ করতে হবে। দুর্বলতা কাটিয়ে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’
দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় সংকট দূর হওয়ার আশা প্রকাশ করে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘এনসিপি সরকারি প্রটোকলে প্রচারণা চালাচ্ছে, এটা দৃষ্টিকটু। প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী ৫ আগস্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে সংকট দূর হবে। কোনো দল যদি সরকারের দল হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে সংকট দূর হবে না বাড়বে।’
সরকার যদি অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী কাজ করে আর সমর্থন পাবে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘এই সরকার বিপদে পড়লেই রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকে। নিবন্ধন (এনসিপি) এখনও পায়নি, অথচ ব্যাপক প্রটোকল দেয়া হচ্ছে। এটা ব্যাপক বৈষম্য। এই সরকার নিরপেক্ষ নয়, সরকার নিরপেক্ষতা হারালে তার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
দিন যত যাচ্ছে দেশ অরাজকতার দিকে এগোচ্ছে উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘কারণ সরকার দুর্বল। অবাধ নির্বাচনের জন্য সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বার বার সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সরকারের নিরপেক্ষতা নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে নিজেদের মধ্যে বিভেদ হলেও দেশ ও জাতির স্বার্থে আবারও এক হতে অসুবিধা নাই। এই সরকার সবচেয়ে দুর্বল হিসেবে এরইমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন আচরণে বৈষম্য ফুটে উঠছে। সব রাজনৈতিক দল, তাদের প্রচারণায় সরকারের পক্ষ থেকে সমান সুযোগ পাচ্ছে না। এনসিপিকে সরকার ব্যাপক প্রটোকল দিয়ে বাকিদের প্রতি পক্ষপাত করছেন। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিচার সংস্কার ও নির্বাচনের দায়িত্ব সরকারের ওপর। অবিলম্বে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা দরকার সরকারের। তাহলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসবে। নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বানাতে হবে। সরকারকে নিরপেক্ষতা প্রমাণে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমান আচরণ করতে হবে।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। সরকার এনসিপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। এনসিপির প্রতি এমন আচরণ বজায় থাকলে সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। পতিত আওয়ামী লীগ যেকোনো ইস্যুতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে অরাজকতা করতে পারে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে যমুনায় যান বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তাদের ঐক্য আরও দৃশ্যমান করার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে সবাই একমত বলে জানান নেতারা।