বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক কার্যকর হয়েছে। ফলে অন্য কোনো দেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে বিভিন্ন হারে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হবে। ট্রাম্প এটাকে পাল্টা শুল্ক বা ‘রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ নাম দিয়েছেন। কিন্তু এর জেরে সারাবিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়। কানাডা, সুইজারল্যান্ডের মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। এক দশকে ভারতের সঙ্গে কিছুটা ঠিক হওয়া সম্পর্কও এখন শুল্কের চপেটাঘাতে বিপর্যয়ের মুখে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শুল্ক চুক্তির সমঝোতায় পৌঁছানোর শেষ দিন। এ সময় সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প দাবি করেন, আমদানি শুল্ক আরোপ করায় এখন থেকে কোটি কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কোম্পানি বিদেশ থেকে পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আনবে, তারা খরচ ভোক্তাদের ওপরই চাপিয়ে দিতে পারে।
বিবিসি জানায়, যে দেশগুলোর ওপর শুল্ক কার্যকর হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ব্রাজিল। দেশটির বেশির ভাগ পণ্যে ৫০ শতাংশ হার প্রযোজ্য। রাশিয়ার তেল কেনায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়, যা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ ঘোষণা করেন ট্রাম্প। ২৭ আগস্টের মধ্যে সমঝোতা না হলে ভারতকেও এ বর্ধিত শুল্ক মোকাবিলা করতে হবে।
বর্তমানে ৩০ শতাংশে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করা চীনের ওপরও শুল্ক বাড়ানোর হুমকি রয়েছে। তারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী ১২ আগস্ট শেষ হবে সময়সীমা।
সময় পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকোও। ট্রাম্প বলছেন, ৯০ দিনের মধ্যে দুই দেশ চুক্তিতে পৌঁছবে। আর কানাডা গত শুক্রবার থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডার মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, যা বেশি কিছু পণ্যকে অতিরিক্ত শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান শুল্ক দেবে ১৯ শতাংশ।
ভারতের বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তা রাকেশ মেহরা বলেন, এ শুল্ক ভারতের পোশাক রপ্তানিতে বড় আঘাত। এটা মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতা থেকে ভারতকে সরিয়ে দেবে। ইন্ডিয়া ডিকোডের প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলেন, প্রভাব জুয়েলারি খাতেও পড়বে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর উরজিৎ প্যাটেল বলেন, (ট্রাম্পের) সাম্প্রতিক ঘোষণায় ভারতের সবচেয়ে বড় ভয়টিই বাস্তবের মুখ দেখল।
প্রথম দফা ২৫ শতাংশ শুল্কা আরোপের পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে নামে নয়াদিল্লি। ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ককে ‘অন্যায্য’ বলে বর্ণনা করেন তারা। ট্রাম্প বলছেন, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনে দেশটিকে সহযোগিতা করছে ভারত। দ্বিতীয় দফায় আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণার পর ভারত এটাকে ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।
যা বলছেন মোদি
হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি আপস করবেন না। গতকাল বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে মোদি বলেন, কৃষক, জেলে ও দুগ্ধ খামারিদের স্বার্থের সঙ্গে ভারত কোনো আপস করবে না, যদি এ জন্য অর্থনৈতিক মূল্যও দিতে হয়। বিবিসি জানায়, চলতি বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর তাঁকে স্বাগত জানাতে যেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ওয়াশিংটন সফর করেন, তাদের সবার আগে ছিলেন মোদি। শুল্ককে কেন্দ্র করে ছয় মাসের মধ্যেই দুই নেতার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
ব্রাজিলের প্রতিক্রিয়া
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা রয়টার্সকে বলেছেন, তাঁর দেশ শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে সরাসরি আলোচনা অপমান ছাড়া কিছু নয়। তিনি নিজেকে অপমান করতে চান না। তবে ব্রাজিল কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবে না। ব্রাজিলের সরকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। দ্য রিও টাইমস জানায়, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে ব্রাজিলের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে; দেশটির এক লাখ ৪৬ হাজার চাকরি হুমকিতে পড়েছে।
চীনের বাণিজ্য সহযোগীরা চাপে
ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করা দেশগুলোকে বেশি চাপে ফেলেছেন। মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। শুল্ক আরোপ কার্যকরে জাপান, হংকং ও চীনের শেয়ারবাজারে উত্থান দেখা গেলেও অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে পতন লক্ষ্য করা গেছে।
এমন এক সময় ট্রাম্পের এ শুল্ক এলো যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বেইজিং সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) যোগ দিতে চীনে যাচ্ছেন মোদি। একটি সূত্র বলছে, সম্মেলনের পাশাপাশি ভারত-রাশিয়া-চীন ত্রিপক্ষীয় আলোচনাও এগোতে পারে। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে ভূরাজনীতিতেও সমীকরণ পাল্টাচ্ছে।