জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ২৩ রাজনৈতিক দল ও জোট মতামত জানিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত আগেই মতামত জানিয়েছিল। গতকাল শুক্রবার শেষ দিনে মতামত দিয়েছে এনসিপি। দলটি জামায়াতের মতোই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়েছে। এনসিপি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ গঠনের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে জুলাই সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে যে বিধান খসড়া অঙ্গীকারনামায় রয়েছে, তা সমর্থন করেছে। এনসিপি জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য নয়, ‘গাইডিং প্রিন্সিপাল’ (অনুসরণীয় মূলনীতি) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন সনদে মতামত দেয়নি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আলী আশরাফ আকন সমকালকে জানান, তারা সনদ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ কমিশনকে জানিয়েছেন। অন্য দলের সঙ্গে আলোচনার পর মতামত জানাবেন।
খসড়া সনদে দুই দফার সংলাপে যে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম দফার সংলাপে ৬২টি সুপারিশে অধিকাংশ দলের ঐকমত্য হয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপে ঐকমত্য হয়েছে ২২টি সুপারিশের ১১টিতে। বাকিগুলোর ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান; দুদক, কর্ম কমিশন, ন্যায়পাল, মহাহিসাবরক্ষক ও নিরীক্ষক নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনের মতো প্রস্তাব। জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলের দুটির সংস্কারে রয়েছে ভিন্নমত।
গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো সনদের খসড়ায় আট দফা অঙ্গীকার রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইন ও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য থাকবে সনদের। সনদ নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারগুলোর কালক্ষেপণ না করে সরকার নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করবে। গত বুধবার মতামতে বিএনপি জানায়, সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রহিত হলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। সংবিধানের সংস্কার নির্বাচনের পর সংসদে হতে হবে।
পরদিন বৃহস্পতিবার দেওয়া মতামতে জামায়াত বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। দলটি যদিও বলছে, তারা মতামত নয়, পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। দলটির বক্তব্য সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দিতে হবে। যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করতে হবে। সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা সমর্থন করেছে জামায়াত।
বিএনপির মতো এনসিপিও জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়ার বিরোধী। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার দলিল। তাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। বরং জুলাই সনদ হবে সংবিধানের গাইডিং প্রিন্সিপাল।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে– এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। সনদে তা রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সুযোগ তৈরি হয়। সংবিধান সংশোধনে সনদকে অনুসরণ করতে হবে। সনদের ব্যত্যয় হয়, এমন কোনো সংশোধন করা যাবে না।
এনসিপি কী মতামত দিয়েছে, প্রশ্নে জাবেদ রাসিন বলেন, এনসিপি সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে গণপরিষদ চেয়েছে। যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো আগামী গণপরিষদ নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো গণপরিষদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এর মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন হবে গণপরিষদ নির্বাচনের তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে। এর পর গণপরিষদই সংসদে রূপান্তর হতে পারে।
সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রহিত করার অঙ্গীকারকে এনসিপি সমর্থন করেছে জানিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, বিএনপি, জামায়াত বা অভ্যুত্থানের শক্তির কেউ তো প্রশ্ন তুলছে না। তুললে আওয়ামী লীগ তুলবে। তাদের এই সুযোগ দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের আগে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকারটি সুস্পষ্ট নয় বলে মতামতে জানিয়েছে এনসিপি। দলটি বলেছে, কী কী সংস্কার আগে বাস্তবায়নযোগ্য, তা কমিশনকে স্পষ্ট করতে হবে। গতকাল এনসিপি, সিপিবি ছাড়াও ৯টি দল মতামত দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশনে। বাংলাদেশ জাসদ বলেছে, সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। দলটি জানিয়েছে, তারা সংবিধানের তপশিল থেকে ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাদ দেওয়ার তীব্র বিরোধী।