১৭ জুন ২০২৫ মঙ্গলবার
প্রকাশ : ৯ জুন ২০২৫, ৯:২৬ পিএম

এ সম্পর্কিত আরও খবর

‘মাছ তো দূরের কথা, একবেলা খাবার পাওয়াই এখন অনেক কিছু’

প্রকাশ : ৯ জুন ২০২৫, ৯:২৬ পিএম

👁 42 views

বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ‘ম্যাডলিন’-এর দিকে। সেই ত্রাণবাহী জাহাজ, যেটিকে আটক করেছে ইসরায়েল। গাজাবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলিন’। পথিমধ্যে আন্তর্জাতিক জলসীমায় সেটিকে আটক করে নিজেদের বন্দর আশদাদে নিয়ে যায় ইসরায়েল। সেই সঙ্গে আটক করে জাহাজটিতে অবস্থানকারী ১২ জনকে। যাঁদের মধ্যে আছেন বিখ্যাত পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। আরো আছেন বেশ কজন সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদ।

এঘটনার পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে আরেকটি বিষয়, নিচু স্বরে। কে এই ম্যাডলিন, যাঁর নামে নামকরণ হয়েছে এই জাহাজটির। জানা গেছে, তিনি একজন নারী মৎস্যজীবী। শুধু তা-ই নয়, তিনি গাজার প্রথম এবং একমাত্র নারী মৎস্যজীবী বলেও একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, তিন বছর আগে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা যখন প্রথম ম্যাডলিন কুলাবের সাথে দেখা করেছিল, তখন তার দুই সন্তান ছিল এবং তৃতীয় সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি গাজা সিটিতে তার স্বামী খাদির বাকরের (৩২) সাথে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। খাদিরও একজন মৎস্যজীবী। ওই সময়ে ম্যাডলিন ইসরায়েলের নৌ-অবরোধের মাঝে যতদূর অনুমতি মিলত, ততদূর মাছ ধরতে যেতেন এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন।

এখন তাঁর বয়স ৩০ এবং তিনি চার সন্তানের জননী। তারা হলো স্যান্ডি (০৬), সাফিনাজ (০৫), জামাল (০৩) আর ওয়াসিলা (০১)।

ম্যাডলিন ১৫ বছর বয়সে মাছ ধরা শুরু করেন। তার বাবার নৌকায় কাজ করতেন। ধীরে ধীরে অন্য জেলেদের মাঝে ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর রন্ধনদক্ষতার জন্যও পরিচিত ছিলেন এলাকায়। তিনি নানা জনপ্রিয় খাবার দারুণ রাঁধতে পারতেন।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হলে দরিদ্র পরিবারটি বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের বাড়ির কাছে একটি বিমান হামলায় ম্যাডলিনের বাবা নিহত হলে তারা রীতিমতো ভেঙে পড়ে। প্রায় ৯ মাসের গর্ভবতী ম্যাডলিনকে নিয়ে তার স্বামী গাজা ছেড়ে প্রথমে খান ইউনিসে, তারপর রাফাহ, দেইর আল-বালাহ এবং নুসাইরাতে পালিয়ে যান।

এখন ম্যাডলিন ও তাঁর পরিবার গাজায় তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে এসেছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত বসার ঘরে একটি জীর্ণ সোফায় বসে আছেন, তার চার সন্তানের মধ্যে তিনজন তার সাথে; এক বছরের শিশু ওয়াসিলা তার কোলে, পাঁচ বছরের সাফিনাজ পাশে এবং তিন বছরের জামাল।

ইসরায়েল কর্তৃক আটককৃত ত্রাণবাহী জাহাজটির নাম তার নামে রাখা হয়েছে শুনে তিনি বললেন, ‘আমি গভীরভাবে আবেগাপ্লুত। আমি এক বিশাল দায়িত্ববোধ এবং কিছুটা গর্ব অনুভব করেছি।’ জাহাজে ১২ জন কর্মী সম্পর্কে ম্যাডলিন বলেন, ‘আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাদের জীবন ও সব সুবিধা পেছনে ফেলে গাজাবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, সমস্ত ঝুঁকি সত্ত্বেও। এটি মানবতা ও আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ প্রকাশ।’

ম্যাডলিন জানান, তিনি আর এখন মাছ ধরতে পারেন না, খাদিরও পারেন না, কারণ যুদ্ধের সময় ইসরায়েল তাদের নৌকা এবং মাছ ধরার সরঞ্জামে ভরা একটি গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। ম্যাডলিন যুদ্ধ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা সব হারিয়েছি।’ কিন্তু তার ক্ষতি শুধু আয়ের নয়। এটি তার পরিচয়—সমুদ্র ও মাছ ধরা নিয়ে তার গভীর সংযোগ—এমনকি মাছ খাওয়ার সাধারণ আনন্দেরও।

ম্যাডলিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এখন মাছ খুব দামি, যদিও-বা পাওয়া যায়! মাছ তো দূরের কথা, একবেলা খাবার পাওয়াই এখন অনেক কিছু!’

সত্যিই গাজায় এখন চলছে তীব্র মানবিক সংকট। খাদ্য, শিশুখাদ্য, পানীয় জল থেকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ—সবকিছুরই তীব্র সংকট চলছে গাজাতে। প্রতিদিন ইসরায়েলি হামলায় নিহত হচ্ছেন ৭০ থেকে ১০০ জন, যাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। অনেক মরদেহ চাপা পড়ে থাকছে ধ্বংসস্তূপের নিচেই, উদ্ধার করার মতো লোকও নেই। হামলায় মারা যাচ্ছে ত্রাণকর্মী, উদ্ধারকর্মী, সংবাদিকসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা থেকে ফিলিস্তিন বা গাজাতে কাজ করতে যাওয়া নানা পেশার মানুষ।

এমন ম্যাডলিন এখন গাজার ঘরে ঘরে। অসহায় মা যারা নিজেদের সন্তানের মুখে ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারছেন না। যাঁরা বলছেন—মাছ তো দূরের কথা, একবেলা খাবার পাওয়াই এখন অনেক কিছু।


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x